সঙ্কটে পনেরোটি গ্রাম
জল সরবরাহ প্রকল্প বন্ধ, ভরসা পুকুরই
গ্রামে পানীয় জলের কল আছে। কিন্তু সেই কল থেকে জল পড়ে না। তাই কোমরে কলসী আর হাতে বালতি নিয়ে জল আনতে ছুটতে হয় তিন কিলোমিটার দূরে। পানীয় জলের অভাবে এলাকার স্কুলে মিড-ডে মিল থেকে শুরু করে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের খাবার রান্না চলছে পুকুরের অপরিস্রুত জলেই। বিপদের ঝুঁকি নিয়েই।
ভূগর্ভের মিষ্টি জলের স্তর বিপজ্জনক ভাবে নেমে গিয়েছে। ‘লবনাক্ত’ অঞ্চলের আওতায় পড়ে গোটা এলাকাই ‘নন টিউবওয়েল জোন’ ঘোষিত হয়েছে। ফলে টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করারও প্রশ্ন নেই। অগত্যা, সাইকেলে বা ভ্যান-রিকশায় জ্যারিকেন-ড্রাম-বালতি চাপিয়ে জল আনা ছাড়া উপায় নেই। ৩০ লিটার পানীয় জল-ভর্তি একটি ড্রাম রিকশায় আনতে খরচই পড়ে যায় ৩০ টাকা। ঘুরিয়ে বললে লিটার-পিছু জলের দাম এক টাকা! সেচের অভাবে ফাঁকা পড়ে বিস্তীর্ণ চাষজমি। জল-সঙ্কটের এমনই ছবি কাঁথি মহকুমা শহরের খুব কাছেই কাঁথি-৩ ব্লকের কুসুমপুর পঞ্চায়েত এলাকায়। পঞ্চায়েত এলাকার ১৪-১৫টি গ্রামের হাজার পনেরো মানুষের পানীয় জলের একমাত্র অবলম্বন ছিল জলসরবরাহ প্রকল্পের ট্যাপকল। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তা দিয়ে জল পড়ে না। পাইপলাইন সেই যে বিগড়েছে, আর ঠিক হয়নি। ডিপ-টিউবওয়েলে নোনাজল ওঠে। শীতের সময়েও তাই গ্রামগুলিতে পানীয় জলের হাহাকার। কুসুমপুর, বিলাসপুর, রসুলপুর, জালালপুর, ফতেপুর, বহিত্রকুন্ডা, ওলমা, সাপাই, কাঠিগাঁর বাসিন্দাদের দূরদূরান্ত থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে আনা ছাড়া আর উপায় থাকে না। কাঁথি পুর-এলাকা থেকেও জল বয়ে নিয়ে আসেন অনেকে। সাইকেলের ক্যারিয়ারে দু’পাশে প্লাস্টিকের জ্যারিকেন বেঁধে জল বয়ে নিয়ে আসার ছবি সকালে এই গ্রামগুলির যে কোনও রাস্তায় দাঁড়ালেই নজরে পড়বে।
জলের খোঁজে। নিজস্ব চিত্র।
গ্রামের মহিলাদের কোমরে কলসী নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে পানীয় জল নিয়ে আসার ছবিও প্রতি দিনের। সেই মহিলাদের অন্যতম পুষ্প সাঁতরা, প্রতিমা মেইকাপ, সন্ধ্যা মান্নাদের কথায়, “বাড়ির পুরুষদের দিয়ে আর কাঁহাতক প্রতি দিন জল আনানো যায়! আবার প্রতি দিন রিকশা করে টাকা গচ্চা দিয়েও তো জল আনানোর সামর্থ্য নেই আমাদের। তাই বাধ্য হয়েই কলসী নিয়ে বেরোতে হয়।” রসুলপুর গ্রামের শ্যামাপদ মান্নার কথায়, “এ ভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে না। তাই অনেকে পুকুরের জলও ফটকিরি দিয়ে বা ফুটিয়ে খাচ্ছেন।” রসুলপুরেরই তারাশঙ্কর মান্না-র কথায়, “এতগুলি গ্রামের মানুষ ওয়াটার সাপ্লাইয়ের জলের উপরেই নির্ভরশীল ছিল। সেই জল সরবরাহটাই বন্ধ। বাধ্য হয়েই দূরদূরান্ত থেকে পানীয় জল বয়ে আনতে হয়। না হলে পুকুরের জলই ভরসা।”
শতাব্দী প্রাচীন রসুলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, বহিত্রকুন্ডা হাইস্কুল---সবর্ত্রই মিড-ডে মিলের রান্না, গর্ভবতী ও বাচ্চাদের খাবার তৈরি হচ্ছে পুকুরের জলেই। রসুলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুসংহত শিশু-বিকাশ প্রকল্পের ১১১ নম্বর কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মী যূথিকা মাইতি জানান, ওই কেন্দ্রে ৬ জন প্রসূতি এবং ১ থেকে ৬ বছর বয়সী ৭৫টি শিশুর দুপুরের খাবার তৈরি হয় পুকুরের জলেই। পরিস্রুত জলের অভাবে যে কোনও দিন মারাত্মক অসুখ ছড়ানোর আশঙ্কা। বহিত্রকুন্ডা হাইস্কুলেও একই অবস্থা। স্কুলের ৯০০ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৬০০ জন মিড-ডে মিলের আওতায়। নোনা জল ওঠা একমাত্র ডিপ-টিউবওয়েলেটির উপরেই নির্ভর করতে হয় বলে জানালেন প্রধান শিক্ষক বঙ্গবীর পাত্র। বিকাশ মাইতি, গোপাল দলাই, বাপি মাইতিদের মতো ছাত্রদের অভিযোগ, “বাড়ির জন্য দূরদূরান্ত থেকে সাইকেলে জ্যারিকেন বেঁধে জল বয়ে আনার কাজটা প্রতি দিন সকালে আমাদেরই করতে হয়। ফলে সকালের পড়াশোনাটাও প্রতি দিন নষ্ট হচ্ছে।”
জালালপুরের শ্রীকান্ত মাইতি, বিলাসপুরের অনিল দলাই, তাপসী দাস, রসুলপুরের গৌতম শীট--প্রত্যেকেরই ক্ষোভ, “মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমরা জল-সঙ্কটে ভুগছি। কেউ কিছু করছে না। জল-সরবরাহ দফতর আর প্রশাসন, সবাই এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতেই ব্যস্ত। আমরা তবে কোথায় যাই!” কুসুমপুরের পঞ্চায়েত প্রধান কবিতা পাহাড়ি থেকে কাঁথি-৩ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অর্ধেন্দুশেখর পণ্ডা--সবাই সমস্যার কথা স্বীকার করে জানিয়েছেন, বিশাল এলাকা জুড়ে পানীয় জলের সমস্যা। রাজ্য সরকারের উদ্যোগ ছাড়া গ্রামপঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষে বিহিত সম্ভব নয়।
কাঁথি-৩ ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক নিশান্ত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “জলসরবরাহ দফতর সূত্রে যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে তারা ইতিমধ্যেই জলাধার, পাম্পহাউস তৈরি করেছে। কিছু টেকনিক্যাল কারণে চালু করতে বিলম্ব হচ্ছে।” একই কথা শোনালেন কাঁথির জলসরবরাহ দফতরের সহকারী বাস্তুকার সুবীর ঘোষও। তাঁর কথায়, “আগে কেশুঁরকুদা পাম্পহাউস থেকে পাইপলাইনে যে জল এনে কুসুমপুর এলাকায় সরবরাহ করা হত, সেই পাইপলাইন দীর্ঘ দিনের পুরনো হওয়ায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জলসরবরাহ তাই বন্ধ। বর্তমানে দফতরের উদ্যোগে নতুন করে ওয়াটার রিজার্ভার, পাম্পহাউস তৈরি করা হলেও বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ সংযোগ হলেই পাম্পহাউস চালু হবে।” তবে কবে বিদ্যুৎ সংযোগ হতে পারেতার জবাব দিতে পারেননি সুবীরবাবু।
কবে বিদ্যুৎ-সংযোগ পেয়ে কুসুমপুরে পরিস্রুত পানীয় জল আসবে---তা এখনও অনিশ্চয়তার কুয়াশায় ঢাকা। আগামী গ্রীষ্মের কথা ভেবে এখন থেকেই আতঙ্কিত গ্রামবাসী।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.