|
|
|
|
|
|
অগ্নিশুদ্ধির প্রহর |
আগুন কোনও উত্তর দেয়নি। কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। জরুরি প্রশ্ন।
সেই প্রশ্ন যার উত্তর একটি পরিবর্তন দাবি করে। লিখছেন শোভন তরফদার |
আজ, ৩১ ডিসেম্বর, বছরশেষের কলকাতায় পড়ে রইল কিছুটা আগুন। স্মৃতির মধ্যে তাপ। এবং সন্তাপও বটে। সেই অগ্নি আজ আমাদের কী জানায়? উত্তর নেই। যন্ত্রণা আছে। জ্বলে-ওঠা শিখায় স্পষ্ট ধরা পড়ে, দীর্ঘকাল ধরে জমে উঠেছিল অনেকটা অবহেলা। অনবধানেই কি খেয়াল করা হয়নি? নাকি, অনভ্যাসই দায়ী? সময়ের কাজ সময়ে করার অনভ্যাস। গড্ডলপ্রবাহকে ভেঙে অন্য কিছু করতে চাওয়ার অনভ্যাস। বিধিভঙ্গ হচ্ছে দেখেও তার সঙ্গে প্রাণপণে মানিয়ে নিতে চাওয়ার অনভ্যাস। সেই স্তূপীকৃত অনভ্যাসই জ্বলে উঠল অসময়ের অগ্নিশিখায়। বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়িয়ে নির্বাক। ফুলকি থেকে ফুলকিতে ছড়াচ্ছে আগুন। সঙ্গে, শ্বাসরোধী ধোঁয়া।
কী দাবি করল সেই আগুন? পরিবর্তন-ই কি? অসহ্য বেদনার সামনে দাঁড়িয়ে মহানগর খেয়াল করল, গভীরে কোথাও সিঁধ কেটেছে কিছু অন্যায়। অনেকেই খেয়াল করিনি। জ্বলন্ত একটি ভবন যেই আমাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল, ভবনের সামনে বন্ধ হয়ে গেল যান চলাচল, দমকে দমকে বাড়ল উৎকণ্ঠা। যাঁদের প্রিয়জন সঙ্কটে বন্দি, তাঁরা তো বটেই, এই যন্ত্রণার বোধ নিতান্ত অনাত্মীয়কেও যেন একটি সুতোয় জুড়ে দিল। ‘মানব-বন্ধন’ শব্দটা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার বশে আপাতত ক্লিশে, হাতে হাত মেলালেই যে বন্ধন হয় না, তা বোঝা গিয়েছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু কখনও, কোনও কোনও বিরল মুহূর্তে বোঝা যায়, তেমন একটি টান কোথাও আছে। যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে, সে কাঁদনে সে-ও কাঁদিল।
এবং, কোথাও প্রথম পুরুষ নেই আর। সমস্তই উত্তম পুরুষ। বহুবচন। আমরা। আমাদের। এই কষ্ট, এই দাহ শুধু মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারের নয়। সকলের। সুতরাং, অকারণে নয়, কিন্তু ভীষণ অকালে এক হল এই মহানগর। জড়ো হল একটি বিপর্যয়ের সামনে। আসলে, একটি সন্ধিক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে বোধ হয় এক হল। তারপর কী হল, কে কী বললেন, সেই বৃত্তান্ত বহুবিদিত। পুনরাবৃত্তি নিরর্থক। অপ্রয়োজনীয়ও বটে। কারণ, বর্ষশেষের নগরে আগুন দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রশ্নচিহ্নের মতো। সন্ধিক্ষণের মতো। বর্ষশেষের একটি দিনের মতো। এই সন্ধিক্ষণ যা এক-কে অন্যের থেকে আলাদা করে দেয়। এই রাজ্যও কি এখন তেমনই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নেই? পরিভাষায় একটি শব্দবন্ধ প্রায়শ ব্যবহার করা হয়। ‘জ্বলন্ত সমস্যা’। নেহাতই বাগধারা, সন্দেহ নেই, কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, তার মধ্যে আছে একটি দহনের ইঙ্গিত। এমন অনেকগুলি জ্বলন কি থেকে গেল এই শহরের জন্য? এই রাজ্যের জন্য?
|
|
অথচ, তার পরে যে সৌজন্য দেখল এই শহর, তার ছোঁয়াচ কি থেকে যাবে নতুন বছরে? যাঁরা প্রাণ বিপন্ন করে, দিবারাত্র এক করে কাজ করলেন কিছু অসহায় মানুষের জন্য, সেই ধারাই কি বয়ে চলবে নতুন বছরে? হাসপাতালের কাছাকাছি বিভিন্ন পল্লি থেকে যে সব মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়লেন উদ্ধারকর্মে, ধোঁয়ার মধ্যে ঢুকে রোগীদের সন্ধান করতে গিয়ে অসুস্থ হলেন নিজেরাই, তাঁরা কি দৃষ্টান্তের মতো থেকে যাবেন? নাকি, বিয়োগ-চিহ্নগুলিই ফাঁকে-ফোকরে মাথা তুলবে ক্রমাগত? ফলে, তাঁদের আমরা স্মরণ করব নেহাতই ব্যতিক্রমের মতো। ব্যতিক্রম, অর্থাৎ, অ-স্বাভাবিক! স্বাভাবিক তাঁরাই, যাঁরা নির্বিকার চিত্তে দেখেন, নগরের রাজপথের ধারে খোলা-মুখ কল থেকে ক্রমাগত জল পড়ে চলেছে। পথের ধারে, বা পথের মধ্যেও পড়ে আছেন কেউ। অবশ্য, তখন তাঁরা যথেষ্ট সাবধানী ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে নেন। গাড়ির মুখও ঘুরিয়ে নেন হয়তো বা। বড়জোর চোখটা ঈষৎ বন্ধ হয় এক লহমার জন্য। তারপর চোখ খোলে। শুরু হয় যার যার নিজস্ব গন্তব্যের সন্ধান। একদা এই নগরীর রাজপথেই এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন এক কবি। তিনি তিক্ত ব্যঙ্গ নিয়ে লিখেছিলেন, সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে পৌঁছবে সকলের আগে সকলেই তাই...
আসলে, কাকে ফাঁকি দিয়ে? নিজেকেই কি নয়? আগুন কোনও উত্তর দেয়নি। কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। জরুরি প্রশ্ন। সেই প্রশ্ন যার উত্তর একটি পরিবর্তন দাবি করে। খোলা রাস্তায়, অজস্র মানুষের চোখের সামনে পড়ে থাকে একটি শরীর। মৃত নয়, তখনও জীবিত। দুর্ঘটনার ফলে ক্রমেই নিভে আসছে তার আয়ু। সেই শরীরের দিকে কি ফিরে তাকায় কেউ? বিরল ব্যতিক্রমের মতো যিনি সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, তাঁর প্রয়াস বিফলে যায় শেষ পর্যন্ত।
তোমার মন নাই? এই প্রশ্ন তো এই মহানগরীর দিকে ছুড়ে দেওয়াই যায়। এ দিক ও দিক ছড়ানো-ছিটোনো আলোর নীচে যে অনেকখানি আঁধার ঢাকা আছে, তার সন্ধান মাঝে মধ্যে, কিছু অ-স্বাভাবিক ঘটনায় বেরিয়ে আসে। যেমন, রাজপথে কার্যত সর্বসমক্ষে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু। যেমন, রাত্রিবেলা অগ্নিকাণ্ডে জ্বলে-ওঠা একটি হাসপাতাল।
যেমন, বোনের অপমান রুখতে গিয়ে তারই সামনে খুন হয়ে যাওয়া একটি ভাই।
এই আগুন কি আনবে পরিবর্তন? অভ্যাসের পরিবর্তন?
যা হয়ে চলেছে, তার প্রশ্নহীন পুনরাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে উৎসব বরাবরই কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তাকে নিয়ে আসতে হবে জনতার সরণিতে। সরাতে হবে প্রচল। প্রয়োজনে বদলাতে হবে উৎসবের প্রাঙ্গণ। ঠিক যেমন ঘটল এই শহরে। চলচ্চিত্র উৎসবের বেলায়। সে রকমই, যে সব অনিচ্ছাকৃত এবং হয়তো ইচ্ছাকৃত অবহেলা, মনকে চোখ ঠারার যে সব প্রশাসনিক কলাকৌশল চালু ছিল দীর্ঘ কাল যাবৎ, সমূলে খারিজ করতে হবে সে সব।
জনগণের গায়ে গভীর রাতের একটি কালান্তক আগুনের তাপ এখনও টাটকা। এমন কড়া শীতেও তাকে মোটেই আরামদায়ক ওমের মতো ঠেকছে না। এই আগুন যেন আমাদের অনিবার্য প্রতিপক্ষ। আগুন নিয়ে খেলা করা হয়েছিল দিনের পর দিন। তারই পরিণতি কি ওই দহন? এমন বীভৎস কিছু মৃত্যু।
সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে মহানগর। তার শরীরে অগ্নিদাহের ক্ষত। সঙ্গে কিছু অনিবার্য আক্ষেপ। যদি এটা করা যেত...! যদি ওটা না হয়ে...! এই সব দংশন ঘিরে জ্বলে উঠেছে লালচে শিখা। সঙ্গে দম-আটকানো ধোঁয়া।
আগুনে হল আগুনময়...
|
ছবি: অর্জুন স্বামীনাথন, সিমা গ্যালারি-র সৌজন্যে |
|
|
|
|
|