ব্যাগ গুছিয়ে...
কাঞ্চনজঙ্ঘার আপন দেশে
ঘুম ভাঙতেই বরফঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার আগুনরঙা সাজ? আছে।
সবুজ পেরিয়ে ঘন সবুজ পাহাড় ক্রমে নীল থেকে ঘন নীল? আছে।
ঘুর্ণিপথের বাঁক পেরোনোর রোমাঞ্চ? আছে।
যে দিকে চাও, জংলা ফুলের রং আর আঁধার নামতেই ঝিঁঝির ডাকের নিস্তব্ধতা? তা-ও আছে।
কিন্তু ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার আপন দেশে’ সিকিমের এই ছোট্ট জনপদ পেলিংয়ের আনাচে-কানাচে যে আরও অনেক কিছুই আছে! আছে পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসের গন্ধ। আছে বৌদ্ধ ধর্মের নানা নিদর্শন। আছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসে ঘেরা ইচ্ছাপূরণের ঠিকানা।
পেলিং থেকেই কয়েক কিলোমিটার দূরে, প্রায় ৬৫০০ ফুট উচ্চতায় ইয়োকসুম। স্থানীয় ভাষায় ‘ইয়োকসুম’-এর অর্থ ‘তিন মহাজ্ঞানী সন্ন্যাসীর মিলনস্থল’। কারণ, ১৬৪১ সালে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে তিব্বত থেকে আসা তিন বিশিষ্ট লামা এখানেই, তখনকার নোরবুগ্যাঙে সিকিমের প্রথম রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেন ফুনসোগ নামগেলকে। উপাধি দেন ‘চোগিয়াল’। নোরবুগ্যাঙের নাম হয় ইয়োকসুম, সদ্য গড়ে ওঠা সিকিমের প্রথম রাজধানী। বাগানে ঘেরা চত্বরটায় ঢুকলে প্রথমেই প্রার্থনাগৃহ। তার অন্দরে বিশাল এক প্রেয়ার-হুইল। দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন রাজ্যাভিষেকের সেই ঐতিহাসিক স্থলে। যেখানে এখনও দাঁড়িয়ে পাথরের বিশাল সিংহাসনটি। এক পাশে পাথরের গায়ে লামা লাতসুন চেম্বোর পদচিহ্ন, সযত্নে সংরক্ষিত। উল্টো দিকে সিকিমের প্রতিটি জায়গা থেকে আনা মাটি-জলে গড়া বিশাল এক স্তূপ, ‘নোরবুগ্যাং চোরতেন’। সেখানেই নাকি পোঁতা রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে প্রজাদের আনা যাবতীয় উপহার, ধনরত্ন। এমনটাই বিশ্বাস সিকিমের। স্থানীয়েরা বলেন, লামারা আসার আগে মূলত লেপচারাই ছিলেন সিকিম বা তৎকালীন দেনজঙের বাসিন্দা। তিব্বত থেকে আসা বৌদ্ধদের সংস্পর্শে এসে গড়ে ওঠে সিকিমিজ প্রজন্ম। স্থানীয়দের বিশ্বাসে ইয়োকসুম এক পবিত্র ‘দেমাজং’-ও (ধানচাষের উপত্যাকা)। গুরু পদ্মসম্ভবের আশীর্বাদপ্রাপ্ত এই গ্রামটি তৃতীয় নয়নের প্রতীক। ইয়োকসুম থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরত্বে, ৭০০০ ফুট উচ্চতায় সিকিমের প্রাচীনতম বৌদ্ধমঠ ‘দুবদি মনেস্ট্রি’। ১৭০১ সালে তৎকালীন চোগিয়াল প্রতিষ্ঠিত এই মঠে হাঁটাপথে উঠতে সময় লাগে এক ঘণ্টারও বেশি। সবুজে ঘেরা চত্বরে পাথরের দোতলা মূল ভবন। মাথায় ঘণ্টার আকারে বিশাল গম্বুজ। নানা রঙের পেন্টিংয়ে সাজানো মঠে রাখা আছে বিভিন্ন সময়ের নানা দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য ধর্মীয় পুঁথি। আছে তিন লামার মূর্তিও। তবে এই মঠটিতে এখন থাকেন এক জনই মাত্র সন্ন্যাসী। তাঁকে আগাম খবর দিয়ে তবেই যাওয়া যায় মঠে।
পর্যটকদের কাছে সিকিমের সবচেয়ে পরিচিত বৌদ্ধমঠ অবশ্য ‘পেমিয়াংসে মনেস্ট্রি’। ১৭০৫ সালে তৈরি এই মঠ ছিল শুধুমাত্র খাঁটি তিব্বতি সন্ন্যাসীদের (তা-শাং) জন্যই। সেই রীতি এখনও মানা হয়। গোটা সিকিমে তাই শুধু এই মঠের লামারাই ‘তা-শাং’। স্থানীয়েরা বলেন, ১৮ শতকে মঠ প্রতিষ্ঠাকালে তৎকালীন রাজা সিকিমে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে প্রতিটি পরিবারের দ্বিতীয় পুত্রের মঠের সন্ন্যাসী হওয়া বাধ্যতামূলক করে দেন। পেলিং থেকে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার দূরে এই মঠের দু’দিক পাহাড়ে ঘেরা। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দা ধরে প্রথমে পৌঁছবেন বিশাল প্রার্থনাকক্ষে। চাতাল পেরিয়ে এর পর পিছন দিকে তিনতলা মূল ভবনের দরজা দিয়ে ঢুকতেই রঙের বাহারে ধাঁধিয়ে যাবে চোখ। মন্ত্র লেখা নানা রঙের পতাকা, পেন্টিং-ভাস্কর্যে সাজানো ঘরের কোথাও নানা আকারের ঘণ্টা, কোথাও বা সার দিয়ে রাখা পুজো দেওয়া চকোলেট-চিপস্-বিস্কুটের টুকরি। শেষমেশ স্কুলবাড়ি ঘুরে দেখে ফেরার পালা। খুদে লামাদের সঙ্গে দিব্যি ভাব জমে যেতেই পারে ততক্ষণে!
সিকিমের আর এক বিখ্যাত মঠ ‘তাশিডিং মনেস্ট্রি’। স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে গুরু পদ্মসম্ভবের ছোড়া তির এসে পড়েছিল এখানেই। আর এক লোককথায় প্রথম চোগিয়ালের অভিষেক কালে তিন লামা দেখেন কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে ঝলমল করছে অলৌকিক এক আলো। সেই আলো যেখানে প্রতিফলিত হয়, ঠিক সেখানেই গড়ে ওঠে মঠ। এখানেই পালিত হয় ভুমচু উৎসব। স্থানীয়েরা জানান, এক বছর ধরে পাত্রে রাখা পবিত্র জলের পরিবর্তন দেখে এই উৎসবে সিকিমের ভবিষ্যদ্বাণী করেন লামারা। পাত্রটি যদি খালি পড়ে থাকে, সে বছর খরার আশঙ্কা। যদি অর্ধেক ভর্তি থাকে, বছর কাটবে সুখে-শান্তিতে। আর যদি ধুলোময়লায় ঘোলা হয়ে যায় জল, অশান্তি আর সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। উৎসবের উদ্দেশ্য আসলে জলের অপচয় রুখে তার শুদ্ধতা বজায় রাখার সচেতনতা তৈরি, বলছেন স্থানীয়েরা।
দেখে আসা যায় র্যাবডেন্সে রুইন্স।
১৬৭০ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত এটিই ছিল সিকিমের দ্বিতীয় রাজধানী। রাজ পরিবারে বিভিন্ন অন্তর্দ্বন্দ্বের সাক্ষী এই রাজধানী নেপালি সেনার আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদেরা। এখনকার র্যাবডেন্সে সেই রাজপুরীরই ভগ্নস্তূপ। ভাঙা রাজবাড়ি, এখানে-ওখানে বৌদ্ধস্তূপের অংশ। কোথাও মাঠের উপরে সার দিয়ে কুয়ো, কোথাও বা বাঁধানো চাতালে মঞ্চের মতো উঁচু নির্মাণ। চিরহরিৎ প্রজাতির গাছ, নানা ধরনের অর্কিড, মসে ঘেরা চত্বরে ঢোকার মুখে একচিলতে হ্রদ। পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ুন গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলের পথে। চড়াই-উতরাই বেয়ে গোটা রাজধানী চত্বরটা ঘুরে দেখতে লাগতে পারে এক ঘণ্টাও। তবে ইতিহাসের আমেজ তাতে ভরপুর।
বৌদ্ধমঠ আর সিকিমের ইতিহাসে মজে থাকার ফাঁকেই দেখে আসতে পারেন খেচোপেরি হ্রদ। স্থানীয়েরা বলেন এই হ্রদের জলের গুণে নানা পুজোআচ্চায় তার ব্যবহার, ঘটে রোগমুক্তিও। এ হ্রদ তাই ইচ্ছাপূরণের। তবে এ হ্রদ নিয়েও আছে নানা বিশ্বাস, লোককথা। তাতে মিলেমিশে এক বৌদ্ধধর্ম থেকে হিন্দুধর্ম। কোনওটিতে বলা হয়, বৌদ্ধগুরু পদ্মসম্ভব এখানেই দীক্ষা দেন যোগিনীদের, কোনওটিতে হ্রদ দেবীর পদচিহ্ন। হিন্দু লোককথায় আবার এখানেই ধ্যানে বসেছিলেন স্বয়ং মহাদেব। আর এক কিংবদন্তী বলে, হ্রদের দেবী খুশি হয়ে এক লেপচা কন্যাকে রত্ন উপহার দেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, হারিয়ে যাওয়া সেই রত্ন লুকোনো আছে হ্রদের জলেই। আর এক লোককথা বলে হ্রদ এলাকা আগে ছিল পশু চরানোর জমি। সেখানেই এক লেপচা দম্পতি হঠাৎ দেখেন আকাশ থেকে দু’টি শঙ্খ এসে পড়ল মাটিতে। তার পরেই ভূমিকম্প। মাটি ফুঁড়ে ফোয়ারার মতো উঠল জল। গড়ে উঠল হ্রদ। সিকিমের বিশ্বাসে সবুজে ঘেরা এ হ্রদ তাই বড় পবিত্র। এতটাই যে, একটা পাতাও পড়ে থাকে না জলে, পাখি এসে তুলে নিয়ে যায়। তবে জলে পড়ে থাকা পাতা তুলে নিয়ে যাচ্ছে পাখি, এমনটা হয় কাথুক হ্রদেও। ইয়োকসুমের এই হ্রদটিও সিকিমের মানুষের কাছে অতি পবিত্র। বলা হয়, এই হ্রদের জল ছিটিয়েই রাজপদে অভিষেক হয় ফুনসোগ নামগেলের।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘার আপন দেশে’ বিশ্বাস আর লোককথারা তাই এ ভাবেই ঘুরপাক খায় পথের বাঁকে। সবুজ বন পেরিয়ে, অঝোর ধারার ঝর্না পেরিয়ে, নীল পাহাড়ের সারি পেরিয়ে। আরও অনেক দূর।
কী ভাবে যাবেন
• ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে পেলিং ঘণ্টা চার-পাঁচের পথ।
ঘোরাঘুরি
• শেয়ারে কিংবা গোটা গাড়ি ভাড়া করে।
কোথায় থাকবেন
• আছে অজস্র হোটেল, লজ, স্থানীয়দের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা।
সঙ্গে রাখুন
• পরিচয়পত্র, প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং অবশ্যই শীতের জামাকাপড়।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.