বিদেশে শক্তিধরদের বিরুদ্ধে ধোনির
অধিনায়কত্ব নিয়ে এ বার প্রশ্ন উঠে গেল
বিশ্বে ক্রিকেটবই কেনার সবচেয়ে ভাল ঠিকানা কী? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটমহলে যে কেউ বলে দেবে। ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট, মেলবোর্ন। মাঠের চার তলায় এমসিজি লাইব্রেরিতেও হাজার হাজার বই রয়েছে। কিন্তু সেগুলো তো আর বিক্রির জন্য নয়। পুরনো এবং দুষ্প্রাপ্য সব বই, যাকে বলে ক্রিকেট কালেক্টর্স আইটেম সেগুলো একমাত্র এই দোকানেই পাওয়া যায়। আর তাই যে দেশ যখন অস্ট্রেলিয়ায় খেলে, তার সফরকারী সাংবাদিকেরা অবধারিত এখানে ভিড় করেন।
তা শুক্রবার বিকেলে বইয়ের দোকানের মালিককে দেখা গেল প্রচণ্ড বিরক্ত। কেননা দিনের মধ্যে বেশ কিছু লোক এসে জিজ্ঞেস করছে, পন্টিংয়ের ওপর কী বই আছে? ভদ্রলোক বললেন, “ভারতের সঙ্গে সিরিজ বলে আরও বেশি করে ব্র্যাডম্যানের ওপর এক তাক ভর্তি দুষ্প্রাপ্য সব বই রেখেছি। তা নয় হঠাৎ করে পন্টিং।” স্যান্টো ক্যারুসো মালিকের নাম। গলায় একগাল হতাশা এনে বললেন, “খদ্দেরগুলো এমন ভাব করল যেন ব্র্যাডম্যান ও তো দশ লাখ বছর আগে খেলত! তার চেয়ে পন্টিং বড়। আসলে একটা টেস্ট অভাবিত জিতে এদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দেখবেন সিডনিতে আবার হারবে।”
তাঁর দোকান থেকেই তখন অস্ট্রেলিয়ার নামী কাগজের সাংবাদিক এ মুহূর্তে ক্রিকেটমহলের সবচেয়ে দামি মানুষটার সঙ্গে সেলফোনে কথা বলছেন। তিনি সিডনি ক্রিকেট মাঠের পিচ প্রস্তুতকারক! মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হল, বরাবরের মতো স্পিনিং ট্র্যাক হবে? নাকি ঘাস-টাস ছেড়ে ঠিক ভারত যা চাইছে না, সেটা পেশ করা হবে? সাংবাদিক ফোন বন্ধ করে জানালেন, ঘাস থাকছে। একটু আগেই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া মিডিয়া বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সিডনির বারো জনের দলে তারা পেস বোলার রায়ান হ্যারিসকে রেখেছে। মানে বহু বহু বছর পর সেই পুরনো ওয়েস্ট ইন্ডিজের আদলে অস্ট্রেলিয়াও চাইছে চার ফাস্ট বোলারের ঘোড়া ছোটাতে!
ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিটের দোকান থেকে দু’শো মিটারের মধ্যে ফেডারেশন স্কোয়ার। মেলবোর্নের সাংস্কৃতিক রাজধানী। আমাদের মোহরকুঞ্জ বা আগেকার মুক্তমঞ্চের মতো। ঢেলে সেখানে প্রস্তুতি চলছে নববর্ষ আবাহনের। আলোকসজ্জা রেডি হচ্ছে। রিহার্সাল দিতে বসে গেছে মিউজিসিয়ানরা। পিছনে স্ক্রিন ফিট করার প্রয়োজনীয় তদারকি চলছে। শনিবার রাত্তিরে এই জায়গাটাকে কেন্দ্র করেই না জড়ো হবে মেলবোর্নের মানুষ! জাঁকজমক, ঐশ্বর্য আর প্রচারে সিডনির নিউইয়ার্স ইভ নয় মেলবোর্ন। কিন্তু এই গোলার্ধের নববর্ষ আবাহনের একটা উজ্জ্বল দিকচিহ্ন তো বটেই।
ক্রিকেট জয়ের ফুরফুরে মেজাজ আবার শহরের বর্ষশেষের উৎসবেও মাত্রা যোগ করেছে। আর পাঁচটা সময় অস্ট্রেলিয়াই ফেভারিট থাকে। তারা জেতে। আবার জেতে। কেউ ততটা আলোড়িত হয় না। কিন্তু এই অস্ট্রেলিয়া তো জনতার মনোভাবেই বেশ দেখা যাচ্ছে, খাতায়-কলমে পরিষ্কার আন্ডারডগ ছিল। নইলে একটা টেস্ট জিতে ওঠায় এমন প্রতিক্রিয়া হয় নাকি? জেমস প্যাটিনসন তো রাতারাতি জাতীয় বীর বনে গিয়েছেন। তিন টেস্টে তাঁর উইকেট সংখ্যা ২০। গড় মাত্র ১৫। এ দিনের কাগজ তাঁর সম্পর্কে লিখেছে, ‘ডেনিস লিলি ইন দ্য মেকিং।’ মেলবোর্ন শহরতলির কাছে ড্যানডিলং এলাকার বাসিন্দা হলেন প্যাটিনসন। স্থানীয় হেইলবেরি কলেজ থেকে পাশ করেছেন। বারো ক্লাসে পড়ার সময় ছিলেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান। ফাস্ট বোলার হয়ে ওঠাটা পরে। অস্ট্রেলিয়ায় এখন তাঁকে নিয়ে যা নাচানাচি হচ্ছে, কলকাতা হলে নির্ঘাত ফেডারেশন স্কোয়ারের বর্ষবরণ উৎসবের মধ্যেই কেউ তাঁর পোস্টার নিয়ে বিক্রি করতে বসে যেত। আর সেই ছবি পরের দিনই বার হয়ে যেত কলকাতার পাতায়!
কলকাতার সঙ্গে আবার প্যাটিনসনের গাঁটছড়াও রয়েছে। আর তার পিছনে এক পাকিস্তানি। বছরখানেক আগে করাচির বাড়িতে বসে চ্যানেল সার্ফ করতে করতে ওয়াসিম আক্রম অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় ক্রিকেট মাঠে মিনিটখানেকের জন্য ঢুকে পড়েছিলেন। আর তখনই লম্বা চওড়া চেহারার অনামী পেস বোলারকে নজর করেন। দু’টো ওভার সেই স্পেল দেখার পরেই আক্রম ফোন ঘোরান কলকাতায়। কেকেআর কোচ ডাভ হোয়াটমোরকে ধরেন। বলেন, “ডাভ, এখুনি একটা ছেলেকে টিভিতে দেখাচ্ছে। স্টার ক্রিকেট খোলো। আর একে কেকেআরে তুলে নাও।” সেই মতো প্যাটিনসনকে তুলে নেয় কেকেআর। কিন্তু অধিনায়ক গম্ভীর অনামী পেসারকে একটা ম্যাচও খেলাননি।
প্যাটিনসনের সঙ্গী পেস বোলার পিটার সিডল। একই ক্লাব। একই রাজ্য দলের জুড়ি। ইয়ারা নদীর ধারে ক্রাউন প্লাজা হোটেলে এ দিন সিডলের সাংবাদিক সম্মেলেন ছিল। সেখানে তিনি রীতিমতো গর্বের সঙ্গে বললেন, “তেন্ডুলকরের উইকেট দু’বার তুলেছি এমসিজি-তে। আবার তুলব। ওর বিপক্ষে বল করার সময় মাথায় রাখি না কাকে বল করছি। যে কোনও এক জন ব্যাটসম্যান এ ভাবে ভাবি।” হয়তো এটাই ঠিক মনোভাব। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে ৩০.৭৮ বোলিং গড় নিয়ে কোনও পেসার তেন্ডুলকর সম্পর্কে অতীতে দৃশ্যত এই মনোভাব দেখায়নি। তেন্ডুলকরকে মনে হল না ভারতীয় মিডিয়ার কেউ সিডলের প্রেস কনফারেন্সের ব্যাপারে কিছু জানাতে পেরেছে বলে। পুরো পরিবার নিয়ে তিনি এ দিন চলে গেছিলেন মেলবোর্নের বাইরে গ্রেট ওশান ড্রাইভে।
অস্ট্রেলিয়ায় রাতারাতি জাতীয় বীর প্যাটিনসন।
অপ্রত্যাশিত একটা দিন ছুটি পেয়ে ভারতীয় ক্রিকেটাররা অনেকেই এখানে আসা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটালেন। সহজবোধ্য। কিন্তু অবাক লাগল ব্যাটসম্যানরা যাঁরা ইংল্যান্ড এবং এখানে ধারাবাহিক ব্যর্থ, তাঁদের কেউ সামান্য অনুশীলনও করলেন না। শনিবার টিম সিডনি উড়ে যাচ্ছে। সে দিনও কোনও ট্রেনিংয়ের ব্যাপার নেই। অথচ সহবাগ এবং গম্ভীর দু’জনের এ বার গোটা বছরে কোনও টেস্ট সেঞ্চুরি নেই। বিদেশের পারফরম্যান্স খুব খারাপ। দেশ-বিদেশ মিলে গড় তিরিশেরও কম। ধোনি ব্যাটে কখনও রান পান না এশিয়ার বাইরে। কিন্তু তার চেয়েও আতঙ্কের এশিয়ার বাইরে তাঁর অধিনায়কত্বের রেকর্ড যে দিকে এগোচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং এ বারের অস্ট্রেলিয়া মিলিয়ে ৮ টেস্ট নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার মধ্যে ৭ হার। তুলনায় বিদেশে সৌরভের ক্যাপ্টেন্সি রেকর্ড অনেক ভাল। এশিয়ার বাইরে ২১ টেস্টে অধিনায়কত্ব করে ৮ হার, ৬ জয়, ৭ ড্র।
এমসিজি-তে হারের জন্য একটা কারণ চিহ্নিত করতে হলে অবশ্যই তীব্র গতির সুইং বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় ব্যাটিং ব্যর্থতা। কিন্তু ব্যাটারদের অভিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে অধিনায়ক ধোনিও হচ্ছেন। দু’ইনিংসেই টেলএন্ডারদের জন্য খুব রক্ষণাত্মক ফিল্ড সাজানোয়। অস্ট্রেলিয়া দু’বারই চাপ থেকে বার হয়ে গেছে ফিল্ডিং ছড়ানো থাকায়। এই মত ইয়ান চ্যাপেলের। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও মনে করেন, বিদেশে অধিনায়ক ধোনিকে ভাল ফল করতে হলে অনেক পজিটিভ হতে হবে।
সৌরভ বলছিলেন, “ওয়ান ডে আর টি-টোয়েন্টি ক্যাপ্টেন হিসেবে ধোনি দারুণ। দেশে খেলা টেস্ট ম্যাচেও ভাল। কিন্তু বিদেশে সেরা কি না বাছতে বললে ওর অনেক আগে আমি কুম্বলে বা দ্রাবিড়কে রাখব।” সৌরভের মতে, বিদেশে বড় টিমের সঙ্গে রান না পেয়ে পেয়ে ধোনির রক্ষণাত্মক মানসিকতাটা এসেছে। “দ্রুত ওকে রান করতেই হবে। পজিটিভ হতে হবে। নইলে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো যাবে না। ধোনিকে দেখি নিজে রান না পেলে একটু নেগেটিভ হয়ে যায়। সেটা করলে চলবে না। অধিনায়কত্ব আলাদা। ব্যাটিং ফর্ম আলাদা।”
অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকেরা বারবার ডানকান ফ্লেচারের কথা বলছেন যে, ফ্লেচার অস্ট্রেলিয়ায় কোচিংয়ের পক্ষে খুব অশুভ। তাঁর রেকর্ড এখানে অ্যাসেজে ১-৯। তাঁরা জানেন না ফ্লেচারের চেয়েও অনেক বড় কাহিনি এখন ধোনি।
২০১১-এর মার্চে যিনি সর্বকালের সেরা ভারত অধিনায়ক আখ্যা পেয়েছেন। এ বারে বেশ কোনও কোনও মনোনয়ন বিচারে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, তাঁর একই বছর কিনা শেষ হচ্ছে চরম লজ্জাজনক এবং ‘কন্ট্রাডিকশন’-এ ভরা বিদেশি রেকর্ড দিয়ে। সাফল্যের হার শতকরা ১২। কে বলতে পারে, সিডনিতে বর্ষবরণের ভেঁপু হয়তো সবার আগে ভারত অধিনায়কই শুনতে চাইবেন!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.