আজই যে বৎসরটি ফুরাইয়া যাইবে, ইতিহাস তাহাকে ১৮৪৮ সালের সমতুল্য বলিয়া বিবেচনা করিবে কি না, তাহা সময় বলিবে। কিন্তু, এই বৎসরের নায়কের নাম যে বিপ্লব, তাহা সংশয়াতীত। গত বৎসর পর্যন্ত যে মহম্মদ বুয়াজিজির সহিত ডেভিড গ্রেবারের দূরত্ব ছিল বহু আলোকবর্ষের, ২০১১ সাল তাঁহাদের মিলাইয়া দিল। টিউনিশিয়ার অকিঞ্চিৎকর ফলবিক্রেতা মহম্মদ বুয়াজিজির আত্মহত্যায় যে আরব বসন্তের সূচনা, বলা চলে, তাহা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডেভিড গ্রেবারের ‘আমরাই ৯৯ শতাংশ’ স্লোগানে তারসপ্তকে পৌঁছাইল। ইতিহাসের কোনও ছাত্র যখন ২০১১ সালের ঘটনাক্রমকে ফিরিয়া দেখিবেন, তখন তিনি হয়তো অবাক হইয়া ভাবিবেন, ঘটনাগুলির মধ্যে যোগসূত্র কোথায়? মাদ্রিদের রাস্তায় যাঁহারা সরকারের বিরুদ্ধে সরব হইয়াছিলেন, তাঁহাদের অবস্থার সহিত বেজিংয়ে জুই বিপ্লবে পথে নামা নাগরিকদের অবস্থার সাযুজ্য পাওয়া দুষ্কর। আরব দুনিয়ার ক্ষোভের সহিত গ্রিসের অথবা ইংল্যান্ডের ক্ষোভের কারণের মিল নাই। আবার, আরব দুনিয়াতেও এক একটি দেশ এক একটি কারণে উত্তাল হইয়া উঠিয়াছে। মিশরের হোসনি মোবারকের শাসনের সহিত সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের শাসনকে এক করা যায় না।
প্রকৃত ইতিহাসমনস্ক মাত্রই বুঝিবেন, ইহাই ইতিহাসের দস্তুর। এই বৎসর পৃথিবীর মানচিত্রে যেখানে যেখানে বিপ্লবের আগুন লেলিহান হইয়াছে, তাহার প্রতিটিতেই ক্ষোভের বারুদের স্তূপ জমিয়া ছিল। সেই ক্ষোভ স্থানীয় কারণে। বিপ্লবের আগুনটিই শুধু আন্তর্জাতিক। ভাবিয়া দেখিলে, ইহা বিশ্বায়িত বিপ্লব। প্রকৃত অর্থেই। বিশ্বায়ন, দার্শনিক ভাবে, ‘মেল্টিং পট’ নহে তাহা স্থানীয় চরিত্রকে অক্ষুণ্ণ রাখিয়াই গোটা দুনিয়াকে এক সূত্রে, মালিকার ন্যায় গাঁথিয়া লয়। ২০১১ সাল সাক্ষী থাকিল, ত্রিপোলি হইতে নিউ ইয়র্ক, আথেন্স হইতে নয়াদিল্লি স্থানীয় ক্ষোভগুলি এক বিশ্ব-বিপ্লব সৃষ্টি করিল। বিশ্বায়নের যাহা প্রধানতম আয়ূধ, সেই তথ্যপ্রযুক্তি যে এই বিপ্লবের বিশ্বায়নেরও সহায়ক হইয়াছে, তাহাতে আশ্চর্যের কিছু নাই।
২০১১ সাল কি বিশ্ব জুড়িয়া একই আদর্শের উদ্যাপনের অসম্ভাব্যতাকেও প্রমাণ করিল না? ১৮৪৮ একটি স্বপ্নের জন্ম দিয়াছিল এক দিন গোটা বিশ্বের সব সর্বহারা মানুষ বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করিয়া সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিবে। তাহার পর ভোলগা এবং টেমস-এ বহু জল বহিয়া গিয়াছে, বিপ্লব হয় নাই। ১৯৮৯ সালের পেরেস্ত্রৈকা ছিল আরও একটি স্বপ্নের আঁতুরঘর ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার স্বপ্নের। বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র আর মুক্ত বাজার অর্থনীতি ভবিষ্যতের দুনিয়ায় ইহাই একমাত্র ব্যবস্থা হইবে। ইতিহাসের ‘অন্তিম অধ্যায়’ অতিক্রম করিয়া যাওয়া বিশ্ব বুঝি অন্য কিছু চাহিতে পারে না। ২০১১ সাল ‘ইতিহাসের শেষ’ দেখিবার এই বালখিল্য প্রচেষ্টাকেও বাতিল করিয়া দিল। এক দিকে যেমন ঘোষণা করিল, বিপ্লব হইতে পারে, সর্বহারার বিপ্লবও হইতে পারে কিন্তু তাহাই ‘একমাত্র’ বিপ্লব নহে; অন্য দিকে বলিয়া দিল, গোটা দুনিয়া এক বর্ণের হইবে না। গণতন্ত্রের দাবিতে বিপ্লব হইতে পারে, সেই বিপ্লব হইতে ইসলামি মৌলবাদী শাসনের জন্ম হইতে পারে; আবার মুক্ত বাণিজ্যের নীতি হইতে রক্ষণশীল অর্থনীতিতে ফিরিবার দাবিও উঠিতে পারে। এই বহুবর্ণ বিশ্বকে বুঝিতে হইবে। তাহাকে নিজের চিন্তার ছকে ঢালিয়া লওয়া অর্থহীন। যাহার শেষ নাই, তাহার ক্ষেত্রে শেষ কথা বলিতে যাওয়া আহাম্মকি। |