বছর শেষের লগ্নে পৌঁছে বহরমপুরের মানুষ নিজেদের সৌভাগ্যের কাছে নতজানু হয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতেই পারেন!
নিরুচ্চারে অনেকেই সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশও করছেন। কারণ অবশ্য দু’টি। ইংরেজি পঞ্জিকার ২০১১ সালটি শেষ হল বহরমপুর শহরের দু’টি অবিস্মরণীয় ঘটনা দিয়ে। বাংলা নাটকের ইতিহাসে ১৫ দিন ধরে নাট্যোৎসবের কোনও অতীত নেই। বহরমপুর রবীন্দ্রসদন সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস গড়ল এ বার। চলতি ডিসেম্বর মাসের ১৫ দিন ধরে সদনে অনুষ্ঠিত হল ‘দেশ বিদেশের নাট্যমেলা’। সেই মেলা শেষ হতে না হতেই বিশ্ববরেণ্য শিল্পী বিরজু মহারাজ পায়ের ছন্দে ও হাতের মুদ্রায় বছরের শেষ তিন তিনটি দিন বহরমপুরের মন ও মনন মাতিয়ে রাখলেন। দিনের বেলায় তিনি দেশ ও বিদেশের নৃত্যশিল্পীদের প্রশিক্ষণ দিলেন আর সান্ধ্যমঞ্চে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন তাঁর সৃষ্ট মুদ্রায় সাধারণ রসবেত্তা থেকে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী পর্যন্ত সব স্তরের রসিক মানুষের মন মজে যাওয়ার আনন্দ-উল্লাস।
আনন্দঘন ওই পরিবেশ, মহারাজের বহরমপুরে আগমন ও তিন দিনের অবস্থান অবশ্য আকাশ থেকে ঝুপ করে পড়ে পাওয়া ধন নয়। তার একটা উজ্জ্বল অতীত রয়েছে। সেই ঐতিহ্য থেকে সাম্প্রতিক অতীতের কিঞ্চিত শোনালেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী নিজেই। মুর্শিদাবাদ জেলার সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে তিনি বলেন, “আমার গুরু ভাই ওস্তাদ আবু দাউদ (প্রয়াত) এই শহরেরই সন্তান। এই শহরের ভূমিপুত্র অরুণ ভাদুড়ির সঙ্গে আমার তুই তোকারি সম্পর্ক। এই শহরের তবলা শিল্পী নিত্যগোপাল সাহা আমার প্রিয় মানুষ।” ওই প্রসঙ্গে বহরমপুর শহরের বর্তমান প্রজন্মের উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিল্পী গৌতম ভট্টাচার্য বলেন, “কয়েক বছর আগেও এই শহরে সারা রাত ধরে চলেছে ভি জি যোগের বেহালা ও জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের তবলার যুগলবন্দি, শ্যামল বসুর তবলা ও মণিলাল নাগের সেতারের যুগলবন্দি, আলি আহমেদ হোসেনের সানাই, সাগিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের সারেঙ্গী। বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব, গহরজান বাঈ-এর খেয়াল, ঠুংরি, ভজন, গজল। কে না এসেছেন এই শহরে রাতজেগে অনুষ্ঠান করতে!”
ওই ঐতিহ্যেরও সুমহান অতীত রয়েছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গীত গবেষক রমাপ্রসাদ ভাস্কর তাঁর ‘সঙ্গীত চর্চায় বহরমপুর সেকাল ও একাল’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “লোকসংগীতের আধারে কীর্তনের সূচনা হলেও পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পরে তাঁর অলোকসামান্য প্রভাবে ও গুণীজনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তা পরিবর্তিত হতে হতে উচ্চাঙ্গসংগীতের গুণে সমৃদ্ধ হয়। বহরমপুর শহরাঞ্চলে চৈতন্যোত্তরকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম চর্চা প্রসারিত হতে থাকলে কীর্তন গানের ব্যাপ্তি ঘটে। নরোত্তম ঠাকুরের (১৫৩১-১৫৮৭) শিষ্য গঙ্গানারায়ণ ঠাকুরের বহরমপুর-সৈয়দাবাদস্থ শ্রীপাট সেসময় সঙ্গীত ও বৈষ্ণবদর্শন চর্চার গৌরবময় পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল। এ কারণে মণিপুর রাজ বৈষ্ণবভাবাপন্ন ভাগ্যচন্দ্র সানন্দে পণ্ডিত গঙ্গানারায়ণ ঠাকুরের কাছে মনোহরশাহী কীর্তনের প্রথাবদ্ধ তালিম নিতে চলে আসেন।”
ওই ঐতিহের সুদূর প্রসারী প্রভাবে বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ রামদাস সেন (১৮৪৫-১৮৮৭) মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিষ্ণুতত্ত্ব বিষয়ক গীত নিয়ে ‘তত্ত্বসঙ্গীত লহরী’ রচনা করেন। ১৯০৫ সালে কাশিমবাজার মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী অবিভক্ত বাংলার সংগীত জগতে ইতিহাস রচনা করেন। ওই বছর তিনি অবৈতনিক ‘বহরমপুর সঙ্গীত সমাজ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠিত ওই সংগীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন সঙ্গীতাচার্য রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী (১৮৩৬-১৯২৫)। রমাপ্রসাদবাবু জানাচ্ছেন, প্রথমে কাশিমবাজার ও পরে খাগড়ায় ওই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সঙ্গীত বিদ্যালয়ের সঙ্গে কীর্তন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও ছিল। ১৯০৭ সালে কাশিমবাজার রাজবাড়িতে প্রথম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন হয়। একই সঙ্গে সেখানে ‘সঙ্গীত সম্মিলনী’ও হয়।
ওই বিষয়ে প্রয়াত কবি সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “এক দিকে সাহিত্য সম্মিলনে বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষীগণ, অন্যদিকে সঙ্গীত সম্মিলনীতে সমাগত ভারতের শ্রেষ্ঠ সংগীত বিশারদ ও মন্ত্রীগণ সকলে মিলিয়া এই যুক্ত অধিবেশনের সৌষ্ঠব বর্ধন করিয়াছিলেন। এরূপ যুক্তভাবে সাহিত্য ও সংগীত সম্মিলনীর বিরাট অধিবেশন কেবল বাংলা কেন ভারতবর্ষেও এই প্রথম বলিলে অত্যুক্তি হয় না।” ওই রাজবাড়ির বদ্যান্যতায় গড়ে ওঠা সংগীত বিদ্যালয়ে থেকে জন্ম নেয় সঙ্গীতাচার্য গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী। তাঁর শিক্ষা ও দীক্ষায় জন্ম নেওয়া অগুনিত কৃতী শিষ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সুখেন্দ গোস্বামী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, ইলা মিত্র, উমা দে (মিত্র), এ কানন, ইভা দত্ত, সাধনা বোস, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, খেয়াল-ঠুংরি-ভজনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী রাধাবিনোদ ঠাকুর ওরফে হাবল ঠাকুর।
পরবর্তীতে বহরমপুরে তথা মুর্শিদাবাদ জেলায় রাগ সংগীতের ঘরানা রক্ষা করেন ওস্তাদ আবু দাউদ (কণ্ঠ), পুলিন পাল (সেতার), নিত্যগাপাল সাহা (তবলা), রাজেন্দ্রপ্রসাদ হাজারি (কণ্ঠ)। এ জেলার মার্গ সংগীতের ওই উজ্জ্বল দিনও সদ্য অতীত। সেই গৌরবময় সাংগীতিক ঐতিহ্যের পতাকা দেশ ও বিদেশে বহন করে চলেছেন মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র অরুণ ভাদুড়ি। ওই ঐতিহাসিক অনুসঙ্গ ছাড়া বহরমপুরে বসে দেশ বিদেশের শিল্পীদের বিরজু মহারাজের পক্ষে তালিম দেওয়া সত্যিই অবাস্তব ছিল! |