বর্ষশেষের রাত। নাটক দেখে উদযাপন। ১৯৯৯-২০১১ এটাই কলকাতার নাট্যদর্শকের অভ্যাস দাঁড়িয়েছে গত কয়েক বছর। মধ্যে ২০০৮-৯ বন্ধ ছিল। গত বছর থেকে আবার ফিরে এসেছে নাট্যস্বপ্নকল্প। ফিরে এসেছে বাংলা সাহিত্য আর বাংলা নাটকের মেলবন্ধন দেখার সুযোগ। যেমনটি বহু কাল আগে মিলত পেশাদার রঙ্গালয়ের স্বর্ণযুগে, শিবরাত্রি বা জন্মাষ্টমীর রাতে।
এক সময় পেশাদার মঞ্চে শিবরাত্রি বা জন্মাষ্টমীর দিন সারা রাত নাটক ছিল বাঁধা। সমীর মজুমদার জানালেন, সাতের দশকে উৎপল দত্ত একবার জন্মাষ্টমীতেই সারা রাত একসঙ্গে তিনটি নাটক করেছিলেন, টিনের তলোয়ার, ঠিকানা এবং সূর্যশিকার। এখনও বহরমপুরে ঋত্বিক নাট্যগোষ্ঠী বা শান্তিপুরে কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের দল সারা রাত নাটকের অনুষ্ঠান করে থাকে।
কলকাতার দশক সেই আমেজ পান বিভাস চক্রবর্তীর উদ্যোগে আয়োজিত নাট্যস্বপ্নকল্প থেকেই। এতগুলো বছর হতে চলল, সাধারণ দর্শকের উদ্দীপনা কিন্তু একই রকম রয়েছে, জানালেন বিভাস। বর্ষশেষের এই অন্য রকম মিলনোৎসবে প্রতি বছর গড়ে ৪৫ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি আছেই।
নাট্যস্বপ্নকল্পের অভিনবত্ব হল, শহর ও জেলার মূলত তরুণ পরিচালকদের একসঙ্গে এক গুচ্ছ টাটকা প্রযোজনা দেখার সুযোগ। প্রতি বছর থাকে একটি নির্দিষ্ট থিম এবং তার উপরে ভিত্তি করেই শুধু এই উৎসবকে মাথায় রেখেই তৈরি হয় স্বল্প দৈর্ঘের এক গুচ্ছ নতুন নাটক। এ বারের থিম যেমন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরই কাহিনি অবলম্বনে নাটক সুমন মুখোপাধ্যায়ের শূন্য শুধু শূন্য নয়, সীমা মুখোপাধ্যায়ের মুক্তি, পলক চক্রবর্তীর বহ্নিপতঙ্গ, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের কানু কহে রাই এবং কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের মরু ও সংঘ। বাংলা ছোট গল্পের থিম বারবারই ফিরে এসেছে নাট্যস্বপ্নকল্পে। গিরিশ ঘোষ থেকে বাদল সরকার, উৎপল দত্ত থেকে মোহিত চট্টোপাধ্যায়-মনোজ মিত্রদের মতো নাট্যকারদের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক, উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার-সত্যজিৎকে ঘিরে রাখা হয়েছে থিম। রাখা হয়েছে শুধু ছোট গল্পের থিমও।
পেশাদার রঙ্গালয়ে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত রমরম করে চলত বাংলা উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি নাটক। বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্রনাথ তো বটেই। সেই সঙ্গে তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, সমরেশ বসু, বিমল মিত্র, নিরুপমা দেবী, শঙ্কর একের পর এক হিট নাটক তৈরি হয়েছে এঁদের লেখা থেকে। তুলনায় গ্রুপ থিয়েটারের মঞ্চে প্রথম দিকে বাংলা গল্প-উপন্যাস ভেঙে নাটক তুলনায় কম হয়েছে। বহুরূপী চার অধ্যায় এবং পরে তৃপ্তি মিত্রের পরিচালনায় ঘরে বাইরে করেছিল। সবিতাব্রত দত্ত করেছিলেন শাস্তি, কাবুলিওয়ালা।
উৎপল দত্ত করতেন তিতাস একটি নদীর নাম।
বীরেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় বিপুল হিট করেছিল ‘গোরা’।
বাংলা উপন্যাস, ছোট গল্প এবং কবিতা ভেঙে নাটক করার ঢেউ গ্রুপ থিয়েটারে অনেক বেশি করে ফিরে এসেছে বরং গত কয়েক বছরে। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই। সেই সঙ্গে অন্য সাহিত্যিকরাও। এবং বিভাস নিজে খোলাখুলি বললেন, তার কৃতিত্বটা প্রধানত তরুণ পরিচালকদেরই। গৌতম হালদার-কৃত মেঘনাদবধ কাব্য, ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় রুদালি এবং মুক্তি, সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ফ্যাতাড়ু, নান্দীকারের সোজন বাদিয়ার ঘাট তুমুল সাফল্য পেয়েছে।
সাড়া ফেলেছে সময় অসময়ের বৃত্তান্ত, কাঙাল মালসাট, নক্সী কাঁথার মাঠ, চিলেকোঠার সেপাই, আকরিক, বিদূষক, দুলিয়া, মাল্যবান, পদ্মানদীর মাঝি। এখনও নিয়মিত অভিনীত হচ্ছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অবলম্বনে ভূতপুরাণ, সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোড়াইচরিতমানস, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ফুড়ুৎ, সত্যজিৎ রায়ের পটলবাবু ফিল্মস্টার।
বাদ নেই শরদিন্দুও। বিভূতিভূষণ আর শরদিন্দুর গল্প নিয়ে এই মুহূর্তে ক্যানভাসার ও ব্যোমকেশ অভিনীত হচ্ছে ব্রাত্য বসুর পরিচালনায়। সেই শরদিন্দুকে দিয়েই এ বারের বর্ষশেষ। নাট্যস্বপ্নকল্পে এটা সীমার দ্বিতীয়, দেবেশের তৃতীয় আর সুমনের চতুর্থ বার অংশগ্রহণ। তিন জনেই এক বাক্যে বললেন, এই উৎসবের প্রতি তাঁদের ভাল লাগার কথা। আর নাটক-পাগল দর্শকের কথা, যাঁরা বছরের শেষ রাতটা ভিড় জমান রবীন্দ্র সদনে। |