নতুন সরকারের বয়স সাত মাস পেরোনোর পর তাদের মোকাবিলায় কোন পথে চলা হবে, তা নিয়ে নতুন করে ধন্দে বিরোধী শিবির! পূর্বগৃহীত কৌশল অনুযায়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আরও ‘সময়’ দেওয়া হবে, নাকি রাস্তায় নেমে পড়া হবে টানাপোড়েন এই নিয়েই। সেই টানাপোড়েন যেমন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের অন্দরে, তেমনই বামফ্রন্টের ভিতরেও।
রাজ্যে ৩৪ বছর পরে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পরে সিপিএমের পলিটব্যুরো আলিমুদ্দিনকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছিল, এখনই সরকার-বিরোধিতায় আদা জল খেয়ে নেমে পড়ার দরকার নেই। সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব এখনও পর্যন্ত সেই ‘কৌশল’ বজায় রেখে চললেও নিচু তলা থেকে ‘চাপ’ আসতে শুরু করেছে। জেলা সম্মেলন-পর্বে প্রতিনিধিরা দাবি তুলছেন, ‘অনেক হয়েছে’! রাজ্য নেতৃত্বকে তাঁরা বলছেন, সরকারের মতিগতি যখন বুঝতেই পারা যাচ্ছে, এ বার রাস্তায় নামুন! কিন্তু আলিমুদ্দিন এখনও ‘তাড়াহুড়ো’য় নারাজ। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যেরা ‘অপেক্ষা’র বার্তাই দিচ্ছেন জেলা সম্মেলনে। নিজেরাও ‘অপেক্ষা’ করছেন।
আলিমুদ্দিন সূত্রের খবর, সে জন্যই সরকারের ২০০ দিনের কাজ নিয়ে তাদের তরফে পুস্তিকার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হলেও তা প্রকাশ করা হয়নি। কারণ, সরকার নিজেই ২০০ দিনের কাজের মূল্যায়ন সংক্রান্ত পুস্তিকা এখনও প্রকাশ করেনি। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “সরকারের জন্য ১০০ বা ২০০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার আমরা কে? সরকারের ১০০ দিনের কাজের আত্মমূল্যায়ন তারা নিজেরাই ঘোষণা করায় আমরাও পাল্টা বই ছাপিয়েছিলাম। এখন দেখা যাক, সরকার কী বলে! অন্তত এটা বলতে পারবে না যে, গত ছ’মাস বিরোধীদের বাধায় কাজ করতে পারেনি!”
শুধু সিপিএমের নিচু তলাই নয়, সরকার-বিরোধিতায় ‘কড়া’ হওয়ার চাপ রয়েছে শরিকদের তরফেও। ফরওয়ার্ড ব্লক যেমন দলীয় মুখপত্রে পরিষ্কারই বলেছে, ‘সরকারের ২০০ দিনের সাফল্য হল বেশি কথা বলা’! চাঁছাছোলা ভঙ্গিতে তারা ব্যাখ্যা দিয়েছে, ১০০ দিন হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজেই বলেছিলেন, তাঁর প্রতিশ্রুত কাজের ৯০% করা হয়ে গিয়েছে। সেই জন্যই সম্ভবত ২০০ দিনের কাজ নিয়ে তিনি নিরুত্তর! ‘তাই ২০০ দিনের কাজের খতিয়ান আমরাই পেশ করছি’, লিখেছে তারা। আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “আর চুপ করে থাকা উচিত বলে মনে হচ্ছে না। তবে প্রতিবাদ তীব্র করার আগে ঠিক তথ্য নিতে হবে যে, সরকার আসলে ঠিক ঠিক কী করেছে। সত্যিই কি ২ লক্ষ ৭৫ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে? কারণ, বিধানসভায় মন্ত্রীরা নানা বিষয়ে নানা রকম বিবৃতি দিচ্ছেন!” তথ্য জোগাড়ের জন্য তথ্যের অধিকার আইন কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন আরএসপি নেতৃত্ব। পক্ষান্তরে, আর এক বাম শরিক সিপিআই রাজ্য সরকারের বেশ কিছু ‘ইতিবাচক’ কাজের কথা রাজ্য সম্মেলনের দলিলে উল্লেখ করে আরও ‘সময়’ দেওয়ার কথা বলেছে। যা থেকে স্পষ্ট, এই নিয়ে শরিকরাও ভিন্নমত।
রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ জেলায় সিপিএমের সম্মেলন সমাপ্ত। বাকি জেলাগুলির সম্মেলন চলছে। সেখানে আলোচনা হচ্ছে, ধান-পাট-আলুর ন্যায্য দাম না-পেয়ে কৃষকেরা সঙ্কটে। পাহাড়-সমস্যা নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে, জঙ্গলমহলের সমস্যারও পূর্ণ সমাধান হয়নি। নতুন জমি-নীতির ‘বাঁধনে’ শিল্পের দমবন্ধ অবস্থা। পরিবহণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুতের মতো একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে সঙ্কট ঘনীভূত। নতুন সরকারের কয়েক মাসের মধ্যেই বারেবারে শিশুমৃত্যু ঘটেছে। অথচ এই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা অন্য মন্ত্রীরা সবেতে সিপিএমকে দোষ দিচ্ছেন! একই ‘মূল্যায়ন’ করেছে ফ ব-ও। সিপিএমের প্রতিটি জেলা সম্মেলনে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর জনাতিনেক করে সদস্যের উপস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদের দাবি, এ বার পথে নেমে পড়া হোক!
তবে রাজ্য নেতৃত্ব সেই দাবিতে এখনও পুরোপুরি সাড়া দিচ্ছেন না। সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “প্রথম ছ’মাসে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে কোনও কথা উঠবে বলেই আমরা মনে করিনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মানুষ, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, ধৈর্যচ্যুত হচ্ছেন। তার প্রভাব পড়ছে দলের স্থানীয় কর্মীদের উপরে। তবু আমরা বলছি, মানুষ যেমন আমাদের সরকারের কাজের মূল্যায়ন করেছেন, তেমন এই অপেক্ষার সময়টা কী ভাবে কাটাচ্ছি সে দিকে নজর রাখছেন। মানুষের উপরে নির্ভর করেই তাই দেখেশুনে নামতে হবে।”
আপাতত সিপিএমের কৌশল, গণসংগঠনগুলিকে আন্দোলনে এগিয়ে দেওয়া। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথা অনুযায়ী, “গণসংগঠন তো কাজ শুরু করেছে। আমাদের পার্টি কংগ্রেস এবং রাজ্য সম্মেলন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ফেব্রুয়ারিতেই (রাজ্য সম্মেলন) পথটা অনেকটা স্পষ্ট হবে।” |