সল্টলেকে ইন্দিরা ভবনের সামনে প্রতিবাদ। মহাকরণের সামনে আচমকা বিক্ষোভ। বহরমপুর থেকে ‘তোপ’।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইন্দিরা ভবনের নামবদলের ঘোষণা করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই ‘ত্র্যহস্পর্শ’ এল জোট-শরিক কংগ্রেসের শিবির থেকে!
রাজ্যে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নানা প্রশ্নেই দুই শরিকের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। ইন্দিরা ভবনের নাম বদলে ‘নজরুল ভবন’ রাখার ঘোষণার অভিঘাত জোট-রাজনীতিতে আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে জোট-শিবিরেই। তৃণমূল নেতৃত্বেরই একাংশের ধারণা, মুখ্যমন্ত্রীর এই সাম্প্রতিকতম ঘোষণার জল গড়াতে পারে ১০, জনপথ পর্যন্ত। কারণ, এখানে স্বয়ং ইন্দিরা গাঁধীর নাম জড়িত এবং সেই সূত্রেই কংগ্রেস রাজনীতির ‘নিয়ামক’ গাঁধী পরিবারে তার রেশ পৌঁছে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। তৃণমূল নেতাদের একাংশের অভিমত, জানতে পারলে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী বিষয়টি ‘ভাল ভাবে’ অবশ্যই নেবেন না। মমতার ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলনে নেমে পড়ে কংগ্রেস সেই সম্ভাবনার ইঙ্গিত স্পষ্টও করে দিয়েছে। এখন দেখার, আগামী কয়েকদিনে ওই প্রতিবাদ কোন পর্যায়ে যায়। দেখারও এ-ও যে, সরকার ওই বিষয়ে আবার ভাবনাচিন্তা করে কিনা। তবে প্রশাসনিক সূত্রের খবর, রাজ্য সরকারের তরফে ইন্দিরা ভবনের নামবদলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। |
ইন্দিরা ভবনের সামনে কংগ্রেসের প্রতিবাদ। ছবি: অর্কপ্রভ ঘোষ |
বিধাননগর টাউন কংগ্রেসের সঙ্গেই বৃহস্পতিবার যৌথ ভাবে সল্টলেকে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ-সভা করেছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কংগ্রেস। পুলিশের সামনেই ইন্দিরা ভবনের ভিতরে ঢুকে পড়ে সেখানে প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার ছবি টাঙিয়ে দেন কংগ্রেস সমর্থকেরা। বিক্ষোভ-সভায় মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও তীব্র কটাক্ষ এবং আক্রমণ করা হয়। রাজ্য সরকার নিজেদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন না-করলে আগামী দিনে গোটা রাজ্যে বৃহত্তর আন্দোলন হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। সরকারের নামবদলের ঘোষণার প্রতিবাদে এ দিন দুপুরে মহাকরণের সামনে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদের সমর্থকেরা আচমকা বিক্ষোভ দেখান। ওই ঘটনায় পুলিশ ৮ জনকে গ্রেফতার করে। সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে ধৃতরা সেন্ট্রাল লক-আপেই অনশন শুরু করেছেন বলে সংগঠনের তরফে দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যতক্ষণ না ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হবে, ততক্ষণ অনশন চলবে। তবে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম জানান, অনশনের খবর তাঁর কাছে নেই। ‘স্বভাবসিদ্ধ’ ভঙ্গিতেই মমতার ঘোষণার কড়া সমালোচনা করে ইন্দিরা ভবনের বদলে মহাকরণের নামই ‘নজরুল ভবন’ করার প্রস্তাব দিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী। বহরমপুরে এ দিন মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের সভায় জেলা সভাপতি অধীর বলেন, “আমি মনে করি, সরকারের ওই সিদ্ধান্ত বাংলার সংস্কৃতি-বিরোধী, বাংলার রুচি-বিরোধী! ব্রিটিশ সরকার যেখানে বসে আমাদের শাসন করত, তাকে রাইটার্স বিল্ডিং (মহাকরণ) বলে। আমার প্রস্তাব, রাইটার্সকে নজরুল ভবন ঘোষণা করা হোক! সরকার মনে করলেই পারে!”
অধীরের দ্বিতীয় প্রস্তাব, “বাংলার সরকার ইন্দিরা ভবনের নাম পরিবর্তন না-করে, ইন্দিরা গাঁধীকে ছোট না-করে যদি নজরুলের জন্মভূমি যেখানে, সেই গ্রামে একটা কিছু তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে করত, তবে সেটাকে তীর্থস্থান বলে ভাবতাম। কোনও এক জনের পরিচয় মুছে দিয়ে নিজের পরিচয়টুকু তুলে ধরার জন্য নজরুল গান বাঁধেননি!” ইন্দিরা ভবনকে ‘নজরুল ভবন’ করার নেপথ্যে অধীর তৃণমূলের ‘অন্য অভিসন্ধি’ দেখছেন। তাঁর কথায়, “আসল উদ্দেশ্য অন্য। বাংলার মাটিতে কংগ্রেসের স্মৃতিগুলিকে আস্তে আস্তে মুছে দাও! কংগ্রেসকে ধূলিসাৎ করে দাও! যেন কংগ্রেসের পরিচয় বহন করার কেউ না-থাকে!”
ইন্দিরা ভবনের সামনে এ দিন বিধাননগর টাউন কংগ্রেসের পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচির আগেই আচমকা জনা পঞ্চাশেক সমর্থক বাড়িটির দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে ইন্দিরা গাঁধীর নামে স্লোগান দিতে থাকেন। সমাবেশ শেষেও এক বার তাঁরা ফের ভবনের দরজায় চড়াও হলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তি হয়। দরজার উপরে তাঁরা টাঙিয়ে দেন ইন্দিরার ছবি। প্রতিবাদ সমাবেশে অরুণাভ ঘোষ, নির্বেদ রায়, মালা রায়ের মতো কংগ্রেস নেতারা রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। ঘটনাচক্রে, ওই তিন নেতানেত্রীই মমতার ‘কড়া সমালোচক’। নির্বেদবাবু বলেন, “ইন্দিরার মৃত্যুর পরে দেশ জুড়ে শোকের যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, তাকে কাজে লাগিয়েই মমতা প্রথম বার সাংসদ হয়েছিলেন। রাজীব গাঁধী ওঁকে স্নেহ করতেন। আজ ইন্দিরা ভবনের নাম বদলে তিনি এই ভাবেই তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন!” নির্বেদবাবুর ও মালাদেবীর অভিযোগ, তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার মহাজাতি সদনে সিনেমা হল তৈরির চেষ্টা করছে। অরুণাভবাবুর বক্তব্য, “ইন্দিরা ভবনের একটা ইতিহাস আছে। এ ভাবে নাম পরিবর্তন করা যায় না।” পাশাপাশি, দেবী ঘোষাল, শুভঙ্কর সরকারের মতো নেতারা অবশ্য অতটা ‘কড়া’ ছিলেন না। তাঁদের কথায় এমন ইঙ্গিতই মিলেছে যে, তাঁরা ‘আলোচনার’ পক্ষপাতী। তাঁরা জানান, নজরুলকে নিয়ে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনার বিরোধী তাঁরা নন। কিন্তু ইন্দিরা ভবনের নাম যেন পরিবর্তন করা না-হয়। তাঁদের দাবি, আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা মেটানো সম্ভব।
ওই নেতাদের সুরেই বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও বলেছেন, আলোচনা করে এগোলে বিতর্ক এড়ানো যেত। পুরুলিয়া জেলা সম্মেলনের ফাঁকে বিমানবাবু এ দিন বলেন, “কাজী নজরুল ইসলাম সর্বজনশ্রদ্ধেয়। তাঁকে নিয়ে কোনও বিতর্ক আমরা চাই না। অন্য কোনও জায়গায় কোনও একটা ভবনকে নজরুলের নামে করা যেত। এর আগে রাজ্যের নাম পরিবর্তনের প্রশ্নে আলোচনা করা হয়েছিল। এটা নিয়েও আলোচনা করা যেত। নজরুলের মতো ব্যক্তিত্বের নাম নিয়ে বিতর্ক সমীচীন নয়।” |