ক্লান্তি কাটাতে সস্তায় মেলে শরীর
ধাবার পেছনটা অন্ধকার, ছোট ছোট গাছের জঙ্গল। তারপর রেললাইন, আর রেললাইন পার হলেই জনবসতি। সামনেই ৩৪ নং জাতীয় সড়ক। তার ওপারেই শাল পিয়ালের ঘন জঙ্গল। ধাবার সামনে পরপর সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছোট গাড়ি থেকে শুরু করে বড় বড় মাল বোঝাই ট্রাক। রাত বাড়ার সাথে সাথে ধাবার আবছা আলোর ভেতর দিয়ে ঘোরাফেরা করে ‘ছায়া শরীর’। হনুমান টুপি দিয়ে মাথা ও মুখ ঢাকা ধাবার কর্মী মাঝবয়সী রতনদা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিয়ে চলে যান ধাবার পেছনে। দু’বার অন্ধকারে টর্চ ঘুরিয়ে ডাক দেন, “হ্যালো হ্যালো’’, অন্ধকার চিরে বেরিয়ে আসেন বছর ৩৫ এর মহিলা। পরনে সস্তার চাদর। ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙ। শরীরে অপুষ্টির চিহ্ন। অসুস্থ স্বামী আর ছেলেকে রেখে তিনি হাসপাতালে আয়ার কাজ করতে আসেন।
যারা এই রাস্তা দিয়ে নিয়মিত লরি চালিয়ে যান এরা তাদের পরিচিত। ট্রাক চালানোর এক ঘেয়ে ক্লান্তি কাটাতে চালকেরা এদের সঙ্গ ভালবাসেন। এক প্রকার সস্তার বিনোদন। কিন্তু ধাবার এই পরিবেশে সবসময় নিরাপত্তা থাকে না। আছে অচেনা ট্রাকচালক বা স্থানীয় সমাজ বিরোধীদের অত্যাচার কিংবা আচমকা পুলিশের হানা। মাঝেমধ্যেই এরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। চালান হন কোর্টে।
কেন এত ঝুঁকি নিয়ে ধাবায় আসেন যৌনকর্মীরা? বরং যৌনপল্লি অনেক বেশি নিরাপদ। সেখানে একটা ঘর আছে, আছে নিরাপত্তা। কান পাতলে শোনা যায় এমন ঘটনাও যেখানে কোন যৌনকর্মী আর লরিচালক বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। তবে দেহ ব্যবসার পাশাপাশি রাত বাড়ার সঙ্গে চোলাই মদ বিক্রির পাশাপাশি আনাগোনা বাড়ে সমাজ বিরোধীদের। হাতবদল হয় আগ্নেয়াস্ত্র, টাকা। কখনও সেটা দেশি, কখনও বা আধুনিক। রাতের অন্ধকারে হাজির হন সেই সব আগন্তুক যারা এলাকাই বাসিন্দা নন। চোখে চোখে কথা হয়, পাশাপাশি বসে মদ খান, চা খান, কথা হয় না। শুধু নিঃশব্দে হাতবদল হয় আগ্নেয়াস্ত্র। পরিবর্তে হাতবদল হয় টাকার। সেটা আবার সবসময় আসল থাকে তাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
নাকাশিপাড়ার বিধায়ক কল্লোল খাঁ বলেন, “বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কোনও কোনও ধাবা নেতাদের প্রশ্রয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। তারা বিভিন্ন অসামাজিক কাজেও জড়িয়ে পড়েছিল। ধাবায় রাতের অন্ধকারে আগ্নেয়াস্ত্রের হাতবদল হত বলেও শুনেছি।” তিনি বলেন, “আমরা সরকারে আসার পর এগুলো বন্ধ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছি। প্রশাসনকেও আরও সক্রিয় হতে বলেছি।’’ জেলার পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিত্র বলেন, “ধাবার ওপর সবসময়ই কড়া নজর রাখা হয়। মাঝেমধ্যে আচমকা হানাও দেওয়া হয়। যৌনকর্মীরা ধরাও পড়েন। তা ছাড়াও যাতে অন্য কোনরকম বেআইনি কাজকর্ম না চলে তার জন্য আমরা খোঁজখবর রাখি। ফোন মারফত খবর পেলে আচমকা হানা দিয়ে অপরাধীদের গ্রেফতার করি।”
যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির সাধারণ সম্পাদিকা ভারতী দে বলেন, “আসলে যারা প্রচণ্ড অভাবের তাড়নায় এই পেশায় আসেন তারা সকলেই যৌনপল্লিতে থেকে নিজেদের চিহ্নিত করতে চান না। এরা আয়া, জোগাড়ে, ঠিকা ঝি এর কাজ করার নাম করে বাড়ি থেকে বের হন। সারারাত আয় করে সকালে বাড়ি ফিরে যান। বাড়ির কেউ কিছুই জানতে পারেন না।’’ শুধু কি তাই? যৌনকর্মীরা জানিয়েছেন, পল্লিতে থাকলে ঘর ভাড়া ছাড়াও একটা মোটা টাকা চলে যায় দালাল ও ‘মাসি’র পকেটে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যাও কম। ফলে আয়টা এক প্রকার নিশ্চিত থাকে। যৌনপল্লিতে এখন ব্যবসার বাজার কিছুটা পড়ে গেছে, তারাও ভিড় জমায় এখানে। শুধু যে স্থানীয় যৌনকর্মীরাই এখানে ভিড় করেন তা নয়, কাজের নাম করে বা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সীমান্ত পার করে যে সব মহিলাদের এ পারে এনে মোটা দামে বিক্রি করা হয়, ভাল করে নজর রাখলে দেখা মেলে তাদেরও। বিশেষ করে এরা রাতের অন্ধকারে হাতবদল হতে হতে চলে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে। অন্তত এমনটাই মনে করেন নারীপাচার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা সংগঠন ‘সেবা’র সম্পাদক বিকাশ মণ্ডল। তিনি বলেন, “বিভিন্ন সময়ে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের উদ্ধার করে আমরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কথাই জানতে পেরেছি। এই সব ধাবায় রাতের অন্ধকারে এরা হাতবদল হয়। বাংলাদেশি মহিলারাও এখানে পাচার হয়। ধাবাগুলো কিন্তু নারী পাচারের অন্যতম আখড়া।’’ তবে শুধুই কি পয়সার লেনদেন? এখানেই কোনও কোনও ট্রাক চালকের সাথে সখ্যতা তৈরি হয় কোন কোন যৌনকর্মীর।

(চলবে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.