গত ছয় মাসে কখনও এত আনন্দ পাননি সিপিএমের নেতারা!
প্রথমে পেট্রোলের দাম, তারপরে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ, এখন লোকপাল বিল নিয়েও তৃণমূল কংগ্রেস তাদের ‘সুরেই সুর মিলিয়েছে’ বলে মনে করছেন কমিউনিস্ট নেতারা এবং তাতে তাঁরা যারপরনাই উল্লসিত। সিপিএম বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের অধিকারের উপরে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক তথা রাজ্যকে বেশি অধিকার দেওয়া নিয়ে বিস্তারিত দলিলও তৈরি করেছে সিপিএম। এখন সেই বিষয়েই সরব হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকপাল বিলে কেন্দ্র রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ তুলে তিনি শুধু বামপন্থী নন, প্রধান বিরোধী দল বিজেপিরও পালের হাওয়া অনেকটা কেড়ে নিয়েছেন। তাতে অবশ্য সিপিএম হতাশ নয়। বরং তৃণমূলের ঘাড়ে বন্দুক রেখে মনমোহন-সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণানোটাই এখন সহজতম পন্থা বলে মনে করছেন সিপিএম নেতারা।
সিপিএমের সন্তুষ্টির কারণ অনেক। প্রথমত, আর্থিক বা সাংবিধানিক প্রশ্নে তৃণমূল কংগ্রেস সিপিএমের পথেই হাঁটছে বলে প্রচার করার সুযোগ মিলছে। দ্বিতীয়ত, যে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের কাছে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টকে হার মানতে হয়েছে, সেই জোটে ফাটল ক্রমশ বাড়ছে। তৃতীয়ত, মন্ত্রিসভায় লোকপাল বিলের অনুমোদনে সায় দিয়ে তৃণমূল সংসদে এসে তার বিরোধিতা করছে বলে দ্বিচারিতার অভিযোগও তুলতে পারছে সিপিএম। চতুর্থত, বিজেপির সঙ্গে সিপিএম হাত মিলিয়েছে বলে সরব হয় তৃণমূল। কিন্তু সংসদে পরিস্থিতি এমন যে লোকপাল বিলে রাজ্যের অধিকারে নাক গলানোর অভিযোগ প্রশ্নে বিজেপি, সিপিএম-তৃণমূল কংগ্রেস এখন একই বিন্দুতে।
সমস্যা একটাই। তৃণমূলের ‘দ্বিচারিতা’ তুলে ধরতে গিয়ে সংসদে তাদের থেকেও পাল্টা খোঁচা সামলাতে হচ্ছে সিপিএম নেতাদের। আজ রাজ্যসভায় তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় যন্তরমন্তরে অণ্ণার মঞ্চে সিপিএম-নেত্রী বৃন্দা কারাটের যোগদান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ নিয়ে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, “অণ্ণার সঙ্গে বামপন্থী ও রামপন্থীরা একইসঙ্গে জড়ো হয়েছিল। আমরা কিন্তু সেখানে যাইনি।” রাজ্যসভায় সীতারাম ইয়েচুরির বক্তৃতার সময় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামীও। মজার কথা হল, ইয়েচুরি নিজেও প্রাথমিক ভাবে দলের মধ্যে অণ্ণার মঞ্চে যোগ দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু সংসদে আজ তাঁকে দলীয় সিদ্ধান্তের পক্ষেই সাফাই দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা অণ্ণার মঞ্চেও যা বলেছি, এখানেও তা বলছি।” পাল্টা আক্রমণে গিয়ে তিনি বলেন, “সংসদে এসে তৃণমূল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাতের বিরোধিতা করছেন, খুবই ভাল কথা। কিন্তু মন্ত্রিসভায় লোকপাল বিল নিয়ে অনুমোদনের সময় তাঁদের এই বোধ কোথায় ছিল? পরের বার থেকে তাঁরা যেন মন্ত্রিসভাতেই যাবতীয় আপত্তি জানিয়ে আসেন।” অণ্ণার মঞ্চে যাঁর উপস্থিতি নিয়ে তৃণমূল কটাক্ষ করছে, সেই বৃন্দা কারাটেরও প্রশ্ন, “এত দিন কি তৃণমূল কংগ্রেস ঘুমিয়ে ছিল? লোকসভায় তাঁরা কেন আপত্তি তুলেও সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছিল?” রাজ্যের নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর কটাক্ষ, “লোকসভায় গোল খেয়ে তৃণমূল এখন রাজ্যসভায় গোল বাঁচানোর চেষ্টা করছে।’’ পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার পর থেকেই মনমরা ছিলেন সিপিএমের নেতারা। তা কাটিয়ে উঠতে, নতুন দিশা খুঁজছে দল। আবার সংসদেও শক্তি কমে যাওয়ায় অনেকের মতে, দলের অবস্থা ‘নখদন্তহীন বাঘের’ মতো। গলা ফাটিয়ে মনমোহন-সরকারের নিন্দা ছাড়া আর কিছু করার নেই। অথচ তাঁদের এ হেন অবস্থার জন্য দায়ী যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই তৃণমূল কংগ্রেসই এখন সিপিএম নেতাদের একমাত্র আনন্দের উৎস। সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট সপ্তাহ কয়েক আগেই বলেছেন, তৃণমূল যদি সিপিএমের বিষয়গুলো কেড়ে নেয়, তা হলেও আপত্তি নেই। অর্থাৎ তাঁরা বোঝাতে চাইছেন, তৃণমূল সব বিষয়েই বামপন্থীদের যুক্তিই গ্রহণ করছেন। সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “আমাদের আদর্শ যদি কেউ অনুসরণ করেন, তা হলে তো খুশি হওয়ারই কথা। দেরিতে হলেও ওঁরা আমাদের কথাই বলছেন। দের আয়ে, পর দুরস্ত আয়ে।”
|