ককটেল-কথা
জেটলি-সিঙ্ঘভি তর্কে রাজ্যসভা যেন কোর্ট
লোকপাল বিলের ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে, সেটা তখনও অস্পষ্ট। সম্ভাব্য ভোটাভুটির লক্ষ্যে অবিরাম দৌত্য চলছে সংসদের অলিন্দে, বিভিন্ন কক্ষে। আর তার সমান্তরালেই রাজ্যসভা যেন আজ হয়ে উঠল পুরোদস্তুর এক আদালত কক্ষ। বিচারপতি নেই ঠিকই। কিন্তু সংবিধানের ধারা তুলে ধরে লড়াই চলল বিরোধী ও সরকার পক্ষের দুঁদে দুই আইনজীবীর মধ্যে। কেন্দ্রকে কাঠগড়ায় তুলে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি অভিযোগ করলেন, “সংবিধানের ধারার অপপ্রয়োগ করছে সরকার। এক দিকে লোকপালকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে চাইছে, অন্য দিকে যে আইন প্রণয়ন করতে চলেছে, তা নিতান্তই ফাঁপা।” পর ক্ষণেই বিশিষ্ট আইনজীবী তথা কংগ্রেস সাংসদ অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি সেই একই সংবিধানকে উদ্ধৃত করে পাল্টা আঘাত করলেন বিরোধীদের। অভিযোগ করলেন, “জেটলি সব জেনে-বুঝেও বিভ্রান্ত করতে চাইছেন দেশকে। বিজেপি-র আসল উদ্দেশ্য হল, যেনতেন প্রকারে বিলের গতিরোধ করা।”
শুধু জেটলি বা অভিষেক নন, রাজ্যসভায় বিএসপি নেতা সতীশ মিশ্র, তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়, এডিএমকে নেতা মৈত্রেয়ণ থেকে শুরু করে রাম জেঠমলানী পর্যন্ত আজ কার্যত আইনজীবীদেরই যুক্তি-তর্কের লড়াই চলেছে রাজ্যসভায়। তবে নিঃসন্দেহে সেই তর্কের জমি তৈরি করে দিয়েছেন জেটলি- অভিষেকই।
লোকপাল বিল নিয়ে বিতর্ক শুরু করতে গিয়ে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা আজ বলেন, সরকার ফৌজদারি দণ্ডবিধি তৈরি করতে চলেছে, না জিলিপির প্যাঁচ দিতে চলেছে, তা স্পষ্ট নয়। কারণ, দুর্নীতির তদন্তের জন্য লোকপাল গঠন করার প্রস্তাব দিচ্ছে সরকার। অথচ প্রকৃত তদন্ত করবে সিবিআই। আবার আদালতে চার্জশিট পেশের অধিকার থাকবে না সিবিআইয়ের। তা করবে লোকপাল। ফলে দুর্নীতির তদন্তের শুনানি হওয়ার আগে সাত-আট হাত ঘুরে জিলিপি ছাড়া আর কী-ই বা তৈরি হতে পারে?
তবে সরকারকে তুলোধোনা করতে জেটলির হাতে আজ মূল অস্ত্র হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের অধিকারের বিষয়টি। কেন না, সেই এক প্রশ্নে আজ সংসদে বিরোধী থেকে শুরু করে সরকারের শরিক তৃণমূল পর্যন্ত এককাট্টা ছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জেটলি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার যে সব আন্তর্জাতিক সনদে সই করে, তা যাতে সারা দেশ মানে সে জন্য সংবিধানের ২৫৩ ধারা ব্যবহার করা হয়। এ বার রাজ্যস্তরে লোকায়ুক্ত নিয়োগের জন্য সেই ধারাটিই প্রয়োগ করতে চলেছে সরকার। অথচ রাজ্যস্তরে লোকায়ুক্ত গঠনের জন্য সংবিধানের ২৫২ ধারাকে অনুসরণ করতে পারত কেন্দ্র। ওই ধারা অনুযায়ী দুই বা ততোধিক রাজ্যের ইচ্ছে অনুসারে সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে এবং অন্য যে কোনও রাজ্য ইচ্ছে করলে তা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার দোহাই দিয়ে মনমোহন সিংহ সরকার রাজ্য সরকারের ক্ষমতা খর্ব করতে চাইছে। তৃণমূলের আশঙ্কা সঠিক। এই আইনের মাধ্যমে রাজ্যের মুখ্যসচিবের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে কেন্দ্র। কিন্তু প্রশাসনিক অধিকার রাজ্যের হাতেই থাকা উচিত। তাতে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ফলে সরকার যা করতে চলেছে, তা একটি সাংবিধানিক ‘ককটেল’।
জেটলির এই দাপুটে বক্তৃতায় আজ বিরোধী বেঞ্চ সমস্বরে বাহবা দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই যুক্তিই কি ঠিক?
এর পরেই বিতর্কে অংশ নিয়ে আইন মন্ত্রক সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান অভিষেক সিঙ্ঘভি বলেন, জেটলি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যাচ্ছেন। দুর্নীতি দমনের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভেনশনে ভারত স্বাক্ষর করেছে। সুতরাং গোটা দেশে
অভিন্ন আইন প্রণয়নের অধিকার রয়েছে কেন্দ্রের। আর সেটা একমাত্র সংবিধানের ২৫৩ ধারা অনুযায়ীই সম্ভব। অতীতে এই ২৫৩ ধারা মেনেই কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরে জাতীয় ও রাজ্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়েছিল। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের আওতায় আবার আইন, শৃঙ্খলা উভয় বিষয়ই রয়েছে। সুতরাং কেন্দ্র এমন আইন করতে পারে। তাদের সেই সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার আইন পড়লে দেখা যাবে, তার প্রথম অংশ হল জাতীয় স্তরে মানবাধিকার কমিশন গঠন সংক্রান্ত। আর দ্বিতীয় অংশে রয়েছে রাজ্য মানবাধিকার গঠনের বিষয়টি।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের অধিকারের প্রশ্নে নয়, লোকপালের আওতায় সিবিআইয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য জেটলির দাবিও আজ জোরালো ভাবে খারিজ করেন অভিষেক। তাঁর কথায়, সিবিআই একটি সত্তর বছরের সংগঠন। কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন দশ বছর পুরনো সংগঠন। প্রশ্ন হল, লোকপাল গঠনের জন্য সিবিআইকে ভেঙে দেবে সরকার? সিবিআই খুন, ধর্ষণ থেকে শুরু করে দুর্নীতি সব বিষয় নিয়ে তদন্ত করে। তার সামগ্রিক প্রশাসনিক অধিকার কী ভাবে লোকপালের আওতায় রাখা যায়? তবে সিবিআইয়ের ওপর নজর রাখার অধিকারও কিন্তু কেন্দ্র প্রস্তাবিত বিলে লোকপালকে দিয়েছে। সিবিআইয়ের ওপর যে নজরদারির কাজ এত দিন ভিজিল্যান্স কমিশন করত, তা এখন লোকপাল করবে। তার পরেই জেটলিকে কটাক্ষ করে অভিষেক বলেন, “ধন্য যে আপনি এটা বলেননি, দুর্নীতির মামলা বিচার করে রায়ও দেবে লোকপাল। ফলে আপনি ‘ককটেলের’ কথা বলে বিভ্রান্ত করতে চাইলেও সেই ‘ককটেলে’ কোনও ঝাঁজ নেই।”
দুঁদে দুই আইনজীবীর লড়াই আজ সাংসদদের মনে এই প্রশ্ন তুলে দেয় যে, শেষ পর্যন্ত কার যুক্তি ঠিক? জবাবে কেন্দ্রের এক শীর্ষ নেতা বলেন, আসলে দু’জনেই নিজের নিজের বক্তব্যে ঠিক। অন্তত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের অধিকারের বিষয়টি নিয়ে। আর তাই বক্তৃতার মাঝে বাধা দিয়ে একে অপরের যুক্তি কাটতে দু’জনের কেউই সচেষ্ট হননি। বরং দু’জন দু’জনের কথা শুনেছেন। আখেরে অনেক দিন পরে একটি ভাল বিতর্কের সাক্ষী হয়ে থেকেছে রাজ্যসভা, তথা সংসদ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.