তৃণমূলকে না পেয়ে পিছিয়ে গেল কেন্দ্র
রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি হয়ে গেল রাজ্যসভা। এবং তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত লোকপাল বিল নিয়ে ভোটাভুটি থেকে মুখ লুকোল মনমোহন সিংহ সরকার। যার ফলে ঝুলে রইল বিলের ভবিষ্যৎ।
রাজ্যসভায় এমনিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই সরকারের। তার উপরে শরিক তৃণমূলের সঙ্গেও সমঝোতা না হওয়ায় অস্বস্তি ও পরাজয় অনিবার্য বুঝে শেষ পর্যন্ত লোকপাল বিল নিয়ে ভোটাভুটি থেকে দূরে সরে রইল সরকার। বিতর্ক দীর্ঘায়িত করে মধ্যরাতে মুলতুবি করে দেওয়া হল রাজ্যসভা। আর তার যুক্তি হিসাবে সরকারের তরফে এটুকুই বলা হল যে, বিরোধী ও শরিকদের আনা প্রায় দু’শোটি সংশোধনী প্রস্তাব বিবেচনার জন্য আরও সময় প্রয়োজন। তাই বিলটি জিইয়ে রেখে সভা মুলতুবি করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। এ-ও জানানো হল, বাজেট অধিবেশনে বিলটি ফের আনা হতে পারে।
কিন্তু নিতান্তই এই যুক্তির আড়ালে কি সত্যিই মুখ লুকোতে পারল সরকার? বরং বিরোধীরা তো বটেই, সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাল শরিক তৃণমূলও। মুলতুবির কয়েক মুহূর্ত আগে সরকারের তীব্র ভর্ৎসনা করে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি জানিয়ে দিলেন, “এই নাটকের চিত্রনাট্য নিঃসন্দেহে প্রাক-পরিকল্পিত। প্রমাণিত যে, সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই ভোটাভুটি থেকে তারা পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে সরকার ভোটাভুটি থেকে পালায়, তার আর এক দণ্ডও দেশ শাসনের অধিকার নেই।” আর শরিক তৃণমূলও জানিয়ে দিল, গণতন্ত্রে আজ আরও একটা শোকের দিন। রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়ের কথায়, “মধ্যরাতে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হল।”
তৃণমূলের এই সমালোচনা ক্ষতের ওপর আর এক বার নুনের ছিটে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, সরকার যে আজ ভোটাভুটি এড়াতে বাধ্য হয়েছে, তার প্রধান কারণ ইউপিএ-র অন্যতম এই শরিক দলের বিরোধিতা। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে রাজ্যসভায় লোকপাল বিল যে পাশের মুখ দেখবে না, এমন আশঙ্কা সরকারের ছিলই। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেস এটাই প্রচার করত যে, সরকার বিলটি পাশ করাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। কিন্তু শেষমেশ বিজেপি-সহ বিরোধীদের আপত্তিতেই তা রাজ্যসভায় পাশ হল না। কিন্তু জোট শরিক তৃণমূলই বিরোধিতা করায় কংগ্রেসের সেই অস্ত্র অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেল বলে মনে করছে বিজেপির একটি বড় অংশ। লোকসভায় পাশ হওয়া লোকপাল বিলে নতুন সংশোধনীর প্রস্তাব এনে তৃণমূল যে ভাবে বিরুদ্ধে ভোটের হুমকি দিয়েছে তা প্রধান অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে কংগ্রেসের।
অবশ্য কংগ্রেস নেতৃত্বের মতে, এর পরেও বিজেপি-র বিরুদ্ধে প্রচারের সুযোগ রইল। তা ছাড়া উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাবে তৃণমূলের কোনও গুরুত্ব নেই। তাই বিজেপি-র ওপর দোষারোপের সুযোগ রইলই। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ বলছেন, শরিককে বাগ মানাতে পারেনি বলেই যে কংগ্রেস বিলটি পাশ করাতে পারল না, সেটা পাল্টা প্রচার করবেন তাঁরা। কংগ্রেস নেতৃত্ব অবশ্য মনে করছেন, আজকের ঘটনা তাৎক্ষণিক। উত্তরপ্রদেশ ভোটে অনেক বেশি করে উঠে আসবে বিরোধীদের ১৮৭টি সংশোধনীর প্রসঙ্গ। কংগ্রেস বলতে পারবে, এই সময়ের মধ্যে এত সংশোধনী দেখে ওঠা সম্ভব ছিল না।
বস্তুত, সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী পবন বনশল এ দিন সভার একেবারে শেষ ভাগে এসে এই যুক্তিই দিয়েছেন। তাতে অবশ্য বাম বা বিজেপি, কেউই দমেনি। অরুণ জেটলি বলেছেন, “আমরা সারারাত বসে বিতর্ক চালাতে প্রস্তুত।” সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, “আমরা আগামিকালও বসতে পারি।” লোকসভায় লোকপাল বিল নিয়ে যাবতীয় আলো যদি নিয়ে যান প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাজ্যসভায় তা হলে ‘মধ্যমণি’ বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি। যিনি বিরোধী দলনেতা হয়েও আসলে সভার গরিষ্ঠ সংখ্যকদের নেতা। সেটা তিনি উল্লেখও করলেন নিজের শেষ ভাগের বক্তৃতায়। লোকসভা-পর্বের পরে বিজেপির উপরে যাবতীয় দায় চাপিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। এমনকী, সনিয়া গাঁধীও। এ দিন কিন্তু সংসদের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেও জেটলি-ইয়েচুরিরা তুলোধোনা করেন সরকারকে।
নিয়ম মতো এ দিন রাত ১২টা বাজলেই এই অধিবেশনের বাড়তি মেয়াদও শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ফলে রাজ্যসভা অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি করে দিতে হবে। সরকার চাইছিল কোনও মতে সেই সময়টায় পৌঁছতে। সে জন্য তারা আরও কিছু পরিকল্পনাও করে রাখে। যেমন, আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদকে দিয়ে মুসলিম সংরক্ষণ সংক্রান্ত (অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের আওতায় আনা) বিবৃতি দেওয়ানো। তাতে হল্লা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তা ছাড়া চিদম্বরমকে নিয়ে আসতেও চেয়েছিল সরকার। টুজি প্রশ্নে তাঁকে বয়কট করছে বিজেপি। ফলে তারা হট্টগোল করত। কিন্তু সরকারের এই চাল বুঝে গিয়ে বিরোধীরা বারবার উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির উপরে রাত ১২টার পরেও সভা চলবে কি না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য চাপ দিতে থাকেন। আনসারি তখন ১৫ মিনিটের জন্য সভা মুলতুবি করেন। পরে সভা চালু হলে বনশল বলতে ওঠেন। তখনও আনসারির রুলিংই চাইছিলেন বিরোধীরা। ১২টা বেজে গেলে আনসারি সভা মুলতুবি করে দেন।
রাজ্যসভার অধিবেশন শুরুর আগে সকালে এক প্রস্ত কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকের পর শরিক তৃণমূলকে বোঝানোর শেষ চেষ্টা করেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু তৃণমূল অনমনীয় থাকায় ক্রমশই বদলে যায় চিত্রটা। ফলে বিকেলে সনিয়া-মনমোহনের উপস্থিতিতে সংসদ ভবনে ফের আর এক দফা বৈঠক করেন কংগ্রেসের রাজনৈতিক ম্যানেজাররা। স্থির হয়, তৃণমূল না হলেও সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি এবং লালু প্রসাদকে বুঝিয়ে রাজি করানো প্রয়োজন। তাঁরা অন্তত হট্টগোল করে সংসদ অচল করে দিতে পারেন। কিন্তু তাতে একমাত্র লালু ছাড়া কেউই রাজি হয়নি। উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে সেখানকার এই দুই দল কংগ্রেসকে এক ইঞ্চিও জমি না ছেড়ে বরং জানিয়ে দেয়, সভায় উপস্থিত থেকে ভোটাভুটিতে অংশ নিয়ে তাঁরা বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। অর্থাৎ, লোকসভায় লোকপাল বিল নিয়ে ভোটাভুটির সময় ওয়াকআউট করে সরকারকে যে সুবিধা করে দিয়েছিলেন তাঁরা সেটুকুও করতে রাজি হননি। এর পর ভোটাভুটিতে বিল পরাস্ত হয়ে যাওয়া তথা বিরোধী ও শরিক তৃণমূলের আনা সংশোধনী পাশ হয়ে যাওয়া অনিবার্য হয়ে ওঠে। যার অর্থ, লোকসভায় পাশ হওয়া বিলটির ফের সংশোধন হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের কাছে দু’টি পথ খোলা ছিল। তা হল, বিলটিকে দুই সভার যৌথ সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সিলেক্ট কমিটিতে সংশোধনের ওপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকত না। আর দ্বিতীয় পথ ছিল, সংশোধিত লোকপাল বিলটি লোকসভায় নিয়ে আসা। যা সংসদের আগামী বাজেট অধিবেশনের আগে সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে সরকার আজ ভোটাভুটি থেকে বিরত থাকারই সিদ্ধান্ত নেয়।
সন্ধ্যা সাতটাতেই তা স্পষ্ট হতে শুরু করে। তখন থেকেই আলোচনা ধীর গতিতে এগোনোর কৌশল নেয় সরকার। তাতেই বিরোধী দলের মনে সংশয় তৈরি হয়। রাজ্যসভায় বিজেপি উপ-দলনেতা সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া সভায় দাঁড়িয়ে বলেন, বাইরে শোনা যাচ্ছে, সরকার সভা মুলতবি করে দেবে।
ঠিক এমন একটা অবস্থায় আরজেডি-র সাংসদদের দিয়ে রাজ্যসভায় গোল পাকানোর একটা শেষ চেষ্টা হয়। রাজ্যসভার দর্শক গ্যালারিতে নিজে বসে ছিলেন লালু। আর সভায় তাঁর তিন সদস্যের অন্যতম রাজনীতি প্রসাদ লোকপাল বিলটি ছিঁড়ে ফেলে হট্টগোল বাধাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু মাত্র তিন জনকে দিয়ে তা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া কংগ্রেসের সেই ‘গেমপ্ল্যান’ বুঝে রীতিমতো সংযত হয়ে বসে থাকে বিরোধী শিবির। কিন্তু তাতেও বিরোধীদের শেষরক্ষা হয়নি। মধ্যরাতে লোকপাল-নাট্যের মাঝপথেই তাতে যবনিকা পড়ে যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.