লোকসভায় যেটা ছিল ‘হ্যাঁ’, রাজ্যসভায় সেটাই ‘না’ হয়ে গেল কেন?
লোকপাল বিলের তীব্র সমালোচনা করলেও লোকসভায় শেষ পর্যন্ত কিন্তু সরকারের পক্ষেই ভোট দিয়েছিল তৃণমূল। কোনও সংশোধনী পেশ করেনি। অথচ রাজ্যসভায় লোকায়ুক্ত-প্রশ্নে সংশোধনী এনে কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জের মুখে কেন ফেললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? আজ সকাল থেকে সংসদের আনাচে-কানাচে এটাই ছিল সব চেয়ে বড় প্রশ্ন। কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বলের তির্যক মন্তব্য, “এখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশ চালাচ্ছে।”
ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার রাতেই। কালীঘাটের বাড়িতে সদ্যপ্রয়াত মায়ের পারলৌকিক অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যেই দিল্লির রাজনীতির দিকে তীক্ষ্ন নজর রাখছিলেন মমতা। লোকসভায় বিতর্ক শেষে যখন ভোটদান হতে চলেছে, তখন তিনি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। এই নির্দেশ দিতে যে, ‘যে ভাষায় লোকপাল বিলের সংশোধন হচ্ছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। কাজেই এই বিলের বিরোধিতা করুন।’ কিন্তু দলীয় সাংসদেরা তখন লোকসভার ভিতরে। ফলে মোবাইলে যোগাযোগ করা যায়নি। তখন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর অতিরিক্ত ব্যক্তিগত সচিব তপন রায়কে ওই নির্দেশ সুদীপ-কল্যাণদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেন মমতা। কিন্তু খবর যত ক্ষণে পৌঁছয়, তত ক্ষণে সরকারের পক্ষে ভোট দিয়ে ফেলেছেন তৃণমূল সাংসদেরা।
এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন মুখ্যমন্ত্রী। সে দিন রাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, রাজ্যসভায় কোনও মতেই সরকারকে সমর্থন করবে না তাঁর দল। আর সেই কারণেই কংগ্রেস আজ রাত পর্যন্ত সংশোধনী প্রত্যাহারের চেষ্টা করলেও কিছুতেই তৃণমূলকে অনড় অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি।
মমতার এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, বিলের কপি তো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। তিনি সেটা পড়েছিলেন। তার পরেও লোকসভায় সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কেন? তখনই তো বিরোধিতা করতে পারতেন। এমনকী, প্রণববাবু যখন কালীঘাটে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন, সে দিন মমতা লোকপালের সমালোচনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই বিলকে সমর্থন করবেন বলেই জানিয়েছিলেন।
এই প্রশ্নের জবাবে তৃণমূল নেতা মুকুল রায় আজ বলেন, “লোকপাল বিলকে এখনও আমরা সমর্থন করি। কিন্তু লোকায়ুক্ত নিয়ে রাজ্যের অধিকারের প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল নেত্রী। কংগ্রেস নেতৃত্ব এ ব্যাপারে তৃণমূলকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁরা যে খসড়া বিলটি তৈরি করছেন তাতে লোকায়ুক্ত নিয়ে রাজ্যের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে। সরকার যখন নিজেই এই দায়িত্ব নিচ্ছে, তখন শরিক হয়ে খামোখা সংশোধনী আনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত লোকসভায় যে বিলটি আনে তাতে কিন্তু রাজ্যের অধিকারের প্রশ্নে বিতর্ক থেকেই যায়। আর সেই কারণেই রাজ্যসভায় সংশোধনী আনতে তৃণমূল বাধ্য হয়েছে।”
মমতা অবশ্য লোকসভার তৃণমূল নেতাদেরও খানিকটা দোষী করছেন। তৃণমূল নেত্রীর মতে, বারবার বলা সত্ত্বেও মঙ্গলবার লোকপাল বিল সম্পর্কে তাৎক্ষণিক বিরোধিতার সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। ওই নেতাদের উচিত ছিল ভোটাভুটির আগে এক বার বাইরে এসে তাঁর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া। যেটা কেউ করেননি। যে-হেতু সর্বদলীয় বৈঠকে গিয়ে সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে এসেছিল তৃণমূল, সে-হেতু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেউ মমতাকে ফোন করে আবার কী করা উচিত, সেটা জানার চেষ্টা করেননি। আর এই কারণেই রাজ্যসভার ক্ষেত্রে মমতা অনেক বেশি সচেতন ছিলেন এবং রাত পর্যন্ত পুরো পরিস্থিতি কলকাতা থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
আইনজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে সংশোধনীগুলি ঠিকমতো করে পেশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় মুকুল রায়কে। ডেরেক ও’ব্রায়ান, সুখেন্দুশেখর রায় এবং দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় সংশোধনীগুলি আনেন। গত কাল বিকেল তিনটে পঞ্চাশ মিনিটে রাজ্যসভার টেবিল অফিসে গিয়ে সেগুলি জমা দেন ডেরেক। আর তার পরেই কংগ্রেস শিবিরে উত্তেজনা ছড়ায়। প্রণব মুখোপাধ্যায় মুকুল এবং ডেরেককে নর্থ ব্লকে ডেকে পাঠান। ঠান্ডায় প্রণববাবুর গলার অবস্থা খারাপ। তা-ও এক ঘণ্টা ধরে তিনি
তৃণমূল নেতাদের বোঝান সংশোধনী প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য। জোট রাজনীতি সামলাতে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে যাওয়া পর্যন্ত বাতিল করে তৃণমূল নেতাদের সময় দেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। কিন্তু দু’-দু’বার চা খাইয়েও বরফ গলেনি।
শেষ পর্যন্ত প্রণববাবু মুকুলদের বলেন, তৃণমূল যদি ওয়াক আউট করে তা-ও ভাল। কিন্তু বিরোধিতা করলে শুধু লোকপাল নয়, সার্বিক ভাবে জোট রাজনীতিতে আঘাত লাগবে। প্রণববাবু তাঁদের লিখে দেন, বিল সরকার সংশোধন করতে পারবেন না। কিন্তু রাজ্যসভায় তিনি বলতে পারেন যে, বিল নিয়ে তৃণমূলের উদ্বেগ নিরসন করা হবে। প্রণববাবুর এই ‘চিঠি’ নিয়ে এর পর তৃণমূল নেতারা চলে আসেন পরিবহণ ভবনে মুকুল রায়ের অফিসে। সেখান থেকে মমতাকে ফোন করা হয়। প্রণববাবুর বক্তব্য তাঁকে পড়ে শোনানো হয় সন্ধ্যা ছ’টায়।
মমতা শুনে বলেন, এই ‘যদি এবং কিন্তু’ সম্বলিত খসড়া মানা সম্ভব নয়। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বকে বলে দেওয়া হোক, এই বিল মানা হবে না। সংশোধনীতেই অটল থাকতে তৃণমূল নেতাদের নির্দেশ দেন মমতা।
মমতাকে ফোন করার আগে বিকেল পাঁচটা থেকে পাঁচটা চল্লিশ পর্যন্ত সংসদের লাইব্রেরিতে আলোচনা করেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদেরা। সেখানে হাজির ছিলেন লোকসভার দুই সাংসদ সুদীপ এবং সৌগত রায়ও।
আজ সকালে আবার ১৫১ সাউথ অ্যাভিনিউতে মুকুলের বাড়ির পার্টি অফিসে সাংসদদের প্রাতরাশ বৈঠক বসে। শীতের হিম সকালেও ৮১ বছরের দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ৩৫ বছরের সৃঞ্জয় বসু সবাই হাজির ছিলেন সেখানে। (ব্যতিক্রম কে ডি সিংহ, অসুস্থ মাকে দেখতে তিনি এখন আমেরিকায়) পরোটা আর আলুর ছেঁচকি খেতে খেতে ফোনে দফায় দফায় মমতার সঙ্গে কথা বলেন নেতারা। গোটা প্রক্রিয়ায় সব চেয়ে সক্রিয় ছিলেন মুকুল, ডেরেক এবং সুখেন্দু।
লোকায়ুক্ত নিয়ে সরকারের বিরোধিতা প্রসঙ্গে মমতা আজ বলেন, “প্রশ্নটা হচ্ছে রাজ্যের অধিকারের। এবং পুরো
বিষয়টির নেপথ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বিজেডি-র ভর্তৃহরি মহতাব। তিনিই প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ
করে বলেন, এই বিল কার্যকর হলে কেন্দ্র রাজ্যকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করবে।” ঠিক এই জায়গাটিই তুলে ধরতে চেয়ে মমতা বলেন, “সরকারকে অস্থির করা আমার লক্ষ্য নয়। দুর্নীতির সঙ্গে
আপস করাও নয়। কিন্তু রাজ্যের অধিকারের প্রশ্নটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়। গোটা দেশের। যা হচ্ছে, তা জরুরি অবস্থা জারি করার থেকেও খারাপ।”
মমতার এই অবস্থানের পরে সংসদে প্রশ্ন এখন একটাই। আজ যে ভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাতে গেলেন মমতা, সেটা কি শুধুই রাজ্যের অধিকারের জন্য? নাকি তিনি ধাপে ধাপে কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছেন? তাঁর অবস্থানের আড়ালে কি রয়েছে কোনও নীল নকসা? |