দিনের শেষে ‘প্রতিবাদী’ মমতাকেই সাধুবাদ দিচ্ছে রাজ্যগুলি।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাতের অভিযোগ তুলে লোকপাল বিলের বিরোধিতায় অনড় রইলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এই অবস্থানে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ। কিন্তু প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিজেপি থেকে শুরু করে আঞ্চলিক দলগুলির সাংসদেরা। তাঁদের বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখার প্রশ্নে কার্যত নতুন এক ‘মমতা-মডেল’ প্রতিষ্ঠিত হল সংসদীয় রাজনীতিতে!
মমতার এই অনমনীয় অবস্থান কিন্তু কংগ্রেসের রাজনৈতিক হিসেবের বাইরে ছিল। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি অথবা খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিষয়গুলি নিয়ে মমতা যে ভাবে বিরোধিতা করেছিলেন, লোকপালের ক্ষেত্রে তা অন্তত হবে না। তাই আজ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজীব শুক্ল, এন কে সিংহ, পবন বনশল, জয়রাম রমেশের মতো কংগ্রেস নেতারা দফায় দফায় তৃণমূল সাংসদদের সঙ্গে কথা বলে মমতাকে নরম করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। কিন্তু বরফ গলেনি। মমতার নির্দেশে আজ রাজ্যসভায় তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় বিলের বিরোধিতা করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বলি দিতে পারব না।”
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাতের বিষয়টিকে মমতা যে ভাবে সামনে নিয়ে এসেছেন, আজ তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন বিজেপি-র অরুণ জেটলি। রাজ্যসভায় তাঁর বক্তৃতায় তিনি বলেন, “এই লোকপাল বিল পাশ হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠমোর উপরে আঘাত আসবে। সব চেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে আঞ্চলিক দলগুলি। এ ক্ষেত্রে সরকারের শরিক হয়েও তৃণমূল যে অবস্থান নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানাচ্ছি। এই অবস্থান না-নিলে কেন্দ্র তো এখানে বসেই যে কোনও রাজ্যে কলকাঠি নাড়বে।” তাঁর প্রশ্ন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবকে কি এখান থেকে বসে নির্দেশ দেওয়া হবে?”
বস্তুত, গত কাল লোকপাল বিলে সংশোধনী নিয়ে জেটলির সঙ্গে আলোচনাও করেছেন তৃণমূল সাংসদ মুকুল রায়, ডেরেক ও’ব্রায়ানরা। এ প্রসঙ্গে মুকুল আজ বলেন, “গোটা বিষয়টি নিয়ে ছোট-বড়ো সব দলের সঙ্গেই আলোচনা করেছি আমরা।”
তৃণমূল আজ যে ভাবে লোকায়ুক্তের বিরোধিতা করেছে, তাতে সমস্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরই খুশি হওয়ার কথা। এমনকী কংগ্রেসের এক নেতাও ঘরোয়া আলোচনায় বলেন, “প্রকাশ্যে যে যা-ই বলুন, কংগ্রেসের কোনও মুখ্যমন্ত্রীও কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না যে, তিনি তৃণমূলের অবস্থানে খুশি নন।” অন্য দিকে বিজেপি-র সব মুখ্যমন্ত্রীও (জোট নিয়ে ৯টি রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে) মমতাকে সমর্থন করছেন।
তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তিনি পদে আসীন থাকবেন কি না, তা রাজ্যের নিজস্ব আইনেই ঠিক হবে। কেন্দ্র লোকায়ুক্তের মাধ্যমে তাতে খবরদারি করতে পারে না। তাঁদের এই অবস্থান কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ঘিরে সনাতন বিতর্ককেই ফের উস্কে দিয়েছে। এবং এই প্রশ্নে তৃণমূলের অবস্থানকে সমর্থন করে আজ দিনভর রাজ্যসভায় গলা ফাটিয়েছেন বহুজন সমাজ পার্টির সতীশ মিশ্র, জেডিইউ-এর শিবানন্দ তিওয়ারি, সমাজবাদী পার্টির রামগোপাল যাদব, ডিএমকে-র শিবা প্রমুখ। প্রত্যেকের বক্তব্যের নির্যাস, রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। |
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর আঘাত নিয়ে এক সময় সব চেয়ে সরব ছিল বামেরা। আন্তঃরাজ্য পরিষদ গঠনের দাবি থেকে সরকারিয়া কমিশন, রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার থেকে মাসুল সমীকরণ নীতি এই সব বিষয় নিয়ে বহু বার সংসদ তোলপাড় করেছে তারা। কিন্তু ইউপিএ সরকারের শরিক হয়েও কেন্দ্র-বিরোধিতার এই পরিসরটা সুকৌশলে দখল করে নিয়েছেন মমতা। পেনশন বিল হোক বা খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি, লোকপাল হোক বা তেলের দাম গত কয়েক মাসে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সিপিএমের থেকে বেশি বই কম মুখর হননি মমতা।
আজ রাজ্যসভায় তৃণমূলের বক্তা সুখেন্দুশেখর রায়ের বক্তৃতার মূল সুরটিও সুদূর কলকাতা থেকে বেঁধে দিয়েছেন মমতাই। গত কাল রাতে ফোনে সুখেন্দুকে সবিস্তার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপরে আঘাতের প্রসঙ্গকেই পাখির চোখ করতে। অন্য বিষয় এসে পড়ে বক্তৃতাকে যেন লক্ষ্যহীন ও ভারাক্রান্ত না করে। লোকপাল বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাদে বিষয়টি সুখেন্দুরওআয়ত্তাধীন। তিনি বলেন, “রাজ্যের আইন ব্যবস্থাকে আঘাত করে এমন কোনও কেন্দ্রীয় আইন আমরা চাই না। যে বিলটি তৈরি করা হয়েছে তা রাজ্যের অধিকারকেই চ্যালেঞ্জ করছে।” |