ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে অসহায় রোগীদের মৃত্যুতেই বুঝি বোধোদয় হল রাজ্য সরকারের!
ওই হাসপাতালের ভিতরে বদ্ধ পরিবেশে ধোঁয়ার গ্রাসে অশক্ত রোগীদের মৃত্যুর জেরে এ বার দমকল আইনটাই নতুন করে ঢেলে সাজার কথা ভাবা হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইনের রদবদল ঘটানো হবে বলে বুধবার জানান দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান। তিনি বলেন, “আমরা ঠেকে শিখেছি। হাসপাতালগুলোয় বিপদের রক্ষাকবচ হিসেবে আপাতত তিনটি সংশোধনী নিয়ে আসার কথা ভাবা হয়েছে।” কাল, শুক্রবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সংশোধনীগুলির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা।
হাসপাতালে আগুনের মোকাবিলায় কী কী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভেবেছে নতুন সরকার?
দমকলমন্ত্রী প্রাথমিক ভাবে তিনটি বিষয়ে জোর দেওয়ার কথা বলছেন।
• হাসপাতালে অবশ্যই একটি বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাতে আগুন লাগার পরে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও বিকল্প বিদ্যুতে হাসপাতাল আলোকিত থাকে। এবং যে-সব রোগীকে বিদ্যুৎচালিত জীবনদায়ী ব্যবস্থায় রাখা হয়েছে, তাঁদের চিকিৎসায় যাতে কোনও ত্রুটি না-হয়।
• হাসপাতালে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা দেখতে এক জন ফায়ার সেফটি অফিসার বা অগ্নি সুরক্ষা আধিকারিক নিয়োগ করতে হবে। কোনও সরকারি দমকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তালিম থাকতে হবে সেই অফিসারের।
• বিপদের সময় রোগীদের নিরাপদে বার করে আনার জন্য হাসপাতালের বাইরে র্যাম্প বা ঢালু পথের ব্যবস্থা করতে হবে। সে-ক্ষেত্রে মই লাগিয়ে কষ্ট করে রোগীদের উদ্ধার করার দরকার হবে না। স্ট্রেচারে শায়িত চলৎশক্তিহীন রোগীদেরও সহজে নীচে নামিয়ে আনা যাবে।
এত দিন এই ব্যবস্থা হয়নি কেন?
এক দমকলকর্তা বলেন, “আগেও হাসপাতালগুলিকে ছাড়পত্র দেওয়ার আগে পরিদর্শনে গিয়ে আমরা এই সব ব্যবস্থা রাখার কথা বলতাম। কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হত না। আইন চালু করে এগুলো বাধ্যতামূলক করা হলে আমাদের হাত কিছুটা শক্ত হবে ঠিকই। তবে নিয়মিত নজরদারিটাই বড় কথা।” ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ বা জাতীয় ভবন বিধিতেও হাসপাতালগুলিকে আগুনের বিপদ ঠেকাতে এই সব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এ বিষয়ে সচেতনতায় ‘চূড়ান্ত খামতি’ আছে বলে মনে করেন দমকলকর্তারাই।
সেই ঘাটতিটা বেআব্রু হয়ে গিয়েছে আমরি-কাণ্ডে। ৮ ডিসেম্বর শেষ রাতে ঢাকুরিয়ার আমরিতে সংলগ্ন ভবনের বেসমেন্টে আগুন লাগার কিছু ক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল বলে জেনেছে পুলিশ। ভোর সওয়া ৪টে নাগাদ দমকল ও পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পরেও হাসপাতাল ছিল পুরো অন্ধকার। ওই অন্ধকারে ধোঁয়ার মধ্যে এগিয়ে রোগীরা কে কোথায় আছেন, তা বুঝতে উদ্ধারকারীদের অনেকটা সময় লেগে যায়। ভেন্টিলেশন যন্ত্র বা অক্সিজেনের নল এঁটে শায়িত রোগীদেরও কেউ কেউ হাসপাতালে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরেই মারা গিয়েছিলেন বলে পুলিশের অনুমান। |
হাসপাতালে অগ্নি সুরক্ষা অফিসার রাখা জরুরি বলে মনে করেন লালবাজারের কর্তারাও। সে-ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি থাকবে কোনও এক জন ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে। হাসপাতালে র্যাম্পের উপযোগিতা নিয়েও পুলিশ-দমকলে কোনও দ্বিমত নেই। আমরিতে ধোঁয়ার মধ্যে ঢুকতে না-পেরে লাগোয়া পঞ্চাননতলা বস্তির যুবক ও দমকলকর্মী— সকলেই মই বেয়ে উঠে চারতলার জানলা ভেঙে ঢুকে রোগীদের বার করার চেষ্টা করেছিলেন। হাসপাতালের প্রতিটি তলার সঙ্গে ভবনের বাইরে র্যাম্পের যোগ থাকলে কাজটা এতটা কঠিন হত না। এত সময়ও লাগত না। আমরি-কাণ্ডের পরে গঠিত দমকলের সেফটি অডিট কমিটি ইতিমধ্যেই আলিপুরে উডল্যান্ডস হাসপাতালে র্যাম্পের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে।
তবে আইনে রদবদল হলেও বাস্তবে তা কবে বলবৎ হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। দমকলমন্ত্রী বলেন, “সংশোধনীগুলি আইনের আওতায় আনতে সমস্যা নেই। মন্ত্রিসভার বৈঠকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে।” তবে ঢের আগে নির্মিত পুরনো হাসপাতালগুলিতে এই ব্যবস্থা চালু করা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে সংশয় আছে খোদ মন্ত্রীরই। তিনি বলেন, “এটা ঠিকই যে, সব হাসপাতালে র্যাম্পের জায়গা নেই। সে-ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অন্য ব্যবস্থাগুলি যথাসম্ভব মেনে চলতে হবে।”
আরও একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছেন মন্ত্রী। নিরাপত্তার কথা ভেবে কোনও হাসপাতাল বন্ধ করার পথে হাঁটতে রাজি নন তিনি। |