প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর স্মৃতি-বিজড়িত ‘ইন্দিরা ভবনে’র নাম বদলে ‘নজরুল ভবন’ করছে রাজ্য সরকার। ওই বাড়িতে নজরুল অ্যাকাডেমি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার মহাকরণে বলেছেন, “জ্যোতি বসু ওই বাড়িতে থাকতেন। ওরা (সিপিএম) ওই বাড়ি ছেড়ে দিতে চেয়েছে। সব আসবাব সরিয়ে নিচ্ছে। ওখানে ‘নজরুল ভবন’ করা হবে। কবি নজরুলকে নিয়ে গবেষণা, মিউজিয়ম সব ওই বাড়িতেই গড়ে উঠবে।”
ইন্দিরা গাঁধীর নামে বাড়িটি বলে তার সঙ্গে যেমন কংগ্রেসের ‘আবেগ’ জড়িত, তেমনই জ্যোতিবাবুর জীবনের শেষ দু’দশকের বাসস্থান বলে সিপিএমেরও ‘আবেগ’ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। সিপিএম অবশ্য ইতিমধ্যেই বাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। তবে ওই বাড়ির নাম নজরুলের নামে রাখার ‘যৌক্তিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তারা। কংগ্রেস স্বভাবতই নাম বদলের সিদ্ধান্তের ‘বিরোধিতা’ করেছে। ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতিবারই ইন্দিরা ভবনের সামনে প্রতিবাদ সভা করার কথা বিধাননগর টাউন কংগ্রেসের। |
ইন্দিরা ভবনের নাম পরিবর্তন নিয়ে নানা মহল থেকে ওঠা প্রশ্নকে অবশ্য এখনই গুরুত্ব দিতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মমতার জবাব, “সব বিষয় নেতিবাচক ভাবে দেখার মানে হয় না!”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য অবশ্য সরাসরিই বলেছেন, “নামবদলটা না-করলেই ভাল হত। ঠিক হয়নি। কারণ, ওই নামের সঙ্গে আলাদা একটা আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে এই নিয়ে রাজ্য সরকারের কোনও আলোচনা হয়নি বলে প্রদীপবাবু জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “নাম বদল না-করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।”
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের মতে, নামকরণ বা স্মারক নিয়ে ‘সংঘাতে’র পথে যাওয়ার ‘উত্তর ভারতের সংস্কৃতি’ এ রাজ্যে চলে আসছে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, “কবি নজরুলের নামে অ্যাকাডেমি হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাজ্যের সব মানুষের জন্যই সেটা হতে পারে। কিন্তু নজরুলের স্মৃতি-বিজড়িত অনেক জায়গা এ রাজ্যে আছে। উদাহরণ হিসাবে কলকাতাতেই সিআইটি রোড এবং ক্রিস্টোফার রোড আছে। সল্টলেকের এই বাড়িটির নাম নজরুল ভবন করার মধ্যে কী নীতি আছে জানি না!” সিপিএম নেতৃত্বের মতে, নজরুল অ্যাকাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান এমন জায়গায় হওয়া উচিত, যেখানে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হবে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জ্যোতিবাবু সল্টলেকের ইন্দিরা ভবনে যে কারণে থাকতেন (নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য), তার সঙ্গে সাধারণের যাতায়াতের কোনও সম্পর্ক নেই।
বস্তুত, তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতারও আশঙ্কা, নামবদল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আগে সিপিএম ওই বাড়িতে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার কথা বলেছিল। তৃণমূল তখন আপত্তি জানায়। দলের এক নেতার ব্যাখ্যা, “এ বার ইন্দিরা ভবনে সংগ্রহশালা গড়ে উঠলেও তা কোনও রাজনৈতিক নেতার নামে হচ্ছে না। নজরুল জনপ্রিয় কবি। তবে নজরুলের নামে অ্যাকাডেমি গড়ে তোলার পিছনে কিছু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও আছে।” প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে ঠিক করেছিলেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের পাশের জমিতে নজরুল অ্যাকাডেমি গড়বেন। সেইমতো প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছিল। তার মধ্যেই তিনি জানতে পারেন, সিপিএম বাড়িটি ছেড়ে দিচ্ছে। তখনই তিনি ওখানে নজরুল অ্যাকাডেমি গড়ার কথা ভাবেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর।
১৯৭২ সালে সল্টলেকে (তৎকালীন লবণহ্রদ) কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অধিবেশনের প্রাক্কালে গড়া হয়েছিল বাড়িটি। তখন সেটির খড়ের চাল। নাম ছিল ‘পর্ণকুটির’। ওই বাড়িতে ইন্দিরা গাঁধীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বাড়িটিতে এ সি মেশিন বসানো নিয়ে সেই সময় বিতর্ক হয়েছিল। পরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলেই বাড়িটি পুরোপুরি গড়ে ওঠে। মুখে মুখে প্রচলিত নাম ছিল ‘ইন্দিরা ভবন’। কিন্তু সরকারি ভাবে ‘ইন্দিরা ভবন’ নামকরণ হয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা প্রয়াত হওয়ার পরে। রাজ্য নগরোন্নয়ন দফতরের অধীনে ওই বাড়িটি অতিথিশালা হিসাবে ছিল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে জ্যোতিবাবু ১৯৮৯ সাল থেকে ওই বাড়িতে থাকতে শুরু করেন বলে জানিয়েছেন তাঁর প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক জয়কৃষ্ণ ঘোষ। বসু ওই বাড়িতে থাকাকালীন বাড়িটিকে ‘ইন্দিরা ভবন’ নামেই সরকারি এবং সিপিএমের দলীয় নথিপত্রে উল্লেখ করা হত।
রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এদিন জানান, এর পর তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর বাড়িটির দায়িত্ব নেবে। জীবনের শেষ ২০ বছর ইন্দিরা ভবনেই কাটিয়েছিলেন জ্যোতিবাবু। তার মধ্যে যখন থেকে বসু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী (নভেম্বর, ২০০০), তখন থেকে এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ির ভাড়া মিটিয়েছে সিপিএমই। ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি বসুর মৃত্যুর পরেও তারাই বাড়িটির ভাড়া দিয়ে আসছে। কিন্তু সিপিএমের তরফে সম্প্রতি রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের পর বাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হবে। জয়কৃষ্ণবাবু বলেন, “এটা ঠিকই জ্যোতিবাবুর সূত্রে বাড়িটির পরিচয় একটা মাত্রা পেয়েছিল। শেষ বার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অবধি তিনি ওই বাড়িতেই থেকেছেন। কিন্তু আমার আবেগে কী আসে যায়! এটা রাজ্য সরকারের বিষয়।”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার চাইলে কোনও সরকারি ভবন বা সম্পত্তির নাম পাল্টাতেই পারে। তার জন্য গেজেট প্রকাশেরও দরকার পড়ে না। এর আগে কলকাতায় ‘সিটিজেন্স পার্ক’-এর নাম পরিবর্তনের সময়েও এমনটা দেখা গিয়েছে।‘সিটিজেন্স পার্ক’ নামে উদ্যানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কলকাতা পুরসভার তৎকালীন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর আমলেই উদ্যানটির নাম বদলে ‘মোহরকুঞ্জ’ (প্রয়াত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকনাম ‘মোহর’ অনুসরণে) রাখা হয়। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক অতীতে ‘ইন্দিরা ভবন’ ছাড়াও নাম পরিবর্তনের উদাহরণ রয়েছে।
বসুর প্রয়াণের পরেই সিপিএম ঠিক করে, তারা ইন্দিরা ভবন ছেড়ে দেবে। বসুর নামে নিউ টাউনে একটি সংগ্রহশালা গড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার জন্য জমিও চিহ্নিত করে দিয়ে গিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। যত দিন না পর্যন্ত বসুর ব্যবহৃত সামগ্রী ইন্দিরা ভবন থেকে সরানো হচ্ছে, তত দিন বাড়িটি ছাড়েনি সিপিএম। কয়েক দিন আগেই প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইন্দিরা ভবন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সিপিএমের রাজ্য নেতা সেলিমের বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরে জ্যোতিবাবুর থাকার জন্য ওই বাড়ির ভাড়া বরাবরই দিয়েছে দল। কিন্তু তিনি থাকতেন বলেই আমরা দাবি তুলিনি যে, ওই বাড়ির নাম জ্যোতি বসুর নামে করতে হবে! বা ৩৪ বছর বামফ্রন্ট সরকার থাকার সময়ও বাড়ির নাম থেকে ইন্দিরা গাঁধীকে ছেঁটে ফেলা হয়নি!” ‘বিতর্ক’ তাই নাম বদলেই! |