সচিনদের পরীক্ষা কঠিন করে দিচ্ছে মেলবোর্নের পিচ
স্ট্রেলিয়ার ‘হেরাল্ড সান’ কাগজে কার্টুনটা বুধবার বেরিয়েছে। ‘ক্লিক’ তীক্ষ্ম আওয়াজ শুনে ছুটে এসেছেন ক্রিকেট অনুরাগী। জিজ্ঞেস করছেন, আচ্ছা তেন্ডুলকরের বেল উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনলাম কি? এমসিজি দর্শক গম্ভীর ভাবে বললেন, “ইন্ডিয়ায় এক কোটি টিভি এক সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মিলিত শব্দব্রহ্ম!”
বৃহস্পতিবার কার্টুনের জ্যান্ত হয়ে যাওয়ার দিন নয় তো? বিপক্ষকে চার উইকেটে ২৭ রানের ঠকঠকানিতে ফেলে দেওয়ার মধ্যে যে মরিয়া নৈপুণ্যের প্রত্যাবর্তন ছিল সেটা তো ক্রমশ দূরে যেতে শুরু করেছে। সকালের আনন্দবাজার হাতে আসার আগেই জানা হয়ে যাবে ভারত কত রানের সামনে পড়ল? আর চতুর্থ ইনিংসের আভাসই বা কী?
বীরেন্দ্র সহবাগ এ সব পরিস্থিতিতে খুব ডাকাবুকো থাকেন। দেখলে মনেই হয় না তিনি যে কোনও চিন্তার মধ্যে আছেন। এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁকে এগিয়ে দেওয়ায় মনে হল ভারত নিশ্চয়ই মিডিয়ায় সদর্থক ভাবনার তরঙ্গ ছড়িয়ে দিতে চাইছে। নইলে সহবাগ কেন? আজ তো কোনও কৃতিত্বের মধ্যেই তিনি নেই। তা সহবাগও দেখা গেল খানিকটা দুশ্চিন্তার ভাঁজে। চতুর্থ ইনিংসে তাঁর ব্যাট চললে কপালের ভাঁজটা মাইকেল ক্লার্কে চালান হয়ে যাবে। এখনকার মতো উদ্বিগ্ন মুখের সহবাগ বলে গেলেন, “তিনশো অবধি তাড়া করা যাবে।” ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়: আড়াইশোর বেশি উঠে গেলে প্রবলেম।
ভারতের ব্যাটিং লাইন-আপ। আর অস্ট্রেলিয়ার অখ্যাত বোলিং। নিছক অ্যাকাডেমিক বিশ্লেষণে দু’টো পাশাপাশি রাখলে চতুর্থ ইনিংসে তিনশো রান তাড়া খুবই সহনীয় মনে হওয়া উচিত। সমস্যা হল টেস্টে যে শুধু ভারত-অস্ট্রেলিয়াই নেই। আর একটা তৃতীয় পক্ষও খুব জোরদার উপাদান হয়ে ঢুকে পড়েছে। যার নাম এমসিজি পিচ। দিনে ১৫ উইকেট যে ধপাধপ খসে গেল তার পিছনে সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা উইকেটের।
বল শুধু সিম করছে না। তাতে বাউন্সই শুধু নেই। সব সময় ঠিকমতো ব্যাটে আসছে না। আচমকা থেমে যাচ্ছে। আজ অন্তত চার জন যে বাইরের বল ব্যাটে লাগিয়ে ইনসাইড-এজ হলেন তার এটাই ব্যাখ্যা, ব্যাটার যে ভাবে বল দেখছে ব্যাটে সে ভাবে পৌঁছচ্ছে না।
এক-এক সময় মনে হচ্ছে প্রথম টেস্টের সেরা দ্রষ্টব্য সচিনের ৭৩ নয়। এমসিজি-র পিচ। সেট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যানকেও যা অস্বস্তিতে রেখে বুঝিয়ে চলেছে, প্রত্যেকটা বলই নতুন বল। স্কোরবোর্ডে তোমার নামের পাশে কত রান লেখা আছে অপ্রাসঙ্গিক।
সিনিয়রদের আরও একটি সাফল্যের দিন। বুধবার মেলবোর্নে মাইক হাসি। ছবি: গেটি ইমেজেস।
রাতে এখানকার স্মিথ স্ট্রিটের আর্ট গ্যালারির ভেতর পিটার রোবাকের স্মরণে আবেগঘন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল একটি ট্রাস্ট। সেখানে বক্তা সাংবাদিক খুব উচ্ছ্বসিত ভাবে বললেন, “অনুমান করার চেষ্টা করছি অথচ পারছি না যে, বেঁচে থাকলে পিটার আজকের ম্যাচটা কী লিখত? কী পূর্বাভাসের কথা বলত?” সামনে ভিড়ের থেকে আর এক অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক বললেন, “ধুর। পুর্বাভাস! এই ভ্যাবচ্যাক ম্যাচ নিয়ে যে লিখতে হল না এটা মৃত্যু-পরবর্তী রোবাকের কাছে প্রথম ভাল খবর।”
দিনের দ্বিতীয় বলেই বোল্ড হয়ে যান রাহুল দ্রাবিড়। বলটা বাড়তি বেঁকেছিল। সচিনেরও গত কাল তাই। কিন্তু এর বাইরে উইকেটগুলো পড়ল স্রেফ টেকনিক্যাল অদক্ষতায়। টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে ডিজাইনার পিচে খেলে খেলে সাবেকি টেকনিকের যে সাড়ে বত্রিশ ভাজা হয়ে গ্যাছে দু’টো টিমেই ক্রমাগত চোখে পড়ছে। আর মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাপী যদি এ ধরনের পিচ আরও হয়, বেশি বয়সিদের গুরুত্ব বাড়বে। এই টেস্টটা তো নিয়ন্ত্রণই করছে তথাকথিত সিনিয়ররা।
সেই সচিন! সেই পন্টিং! সেই হাসি! সেই দ্রাবিড়! বুড়োদের তা হলে সরানো হবে কী করে? সরিয়ে কাদের আনা হবে? অস্ট্রেলিয়া তো গত দু’বছর ধরে গ্রেগ চ্যাপেলের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে কত ট্রেনিং প্রকল্প করেছে। করেও কঠিন সেঞ্চুরি পার্টনারশিপে দলকে ছায়া দেওয়ার জন্য সেই হাসি-পন্টিং। যাঁদের এখনই বাদ দেওয়ার কথা হচ্ছিল। পন্টিং সাংবাদিক সম্মেলনে বেশ খানিকটা রুক্ষ ভাবেই বললেন, “কারা কী নেগেটিভ কথাবার্তা বলছিল পাত্তা দেওয়াই প্রয়োজন মনে করিনি। আসলে কিছু শুনিইনি। শুনেছি যেখান থেকে শুনলে কাজের কাজ হবে। আমার খেলাটার উন্নতি করতে চেয়ে আমি কেবল সেই জানলা কয়েকটা খোলা রেখেছিলাম।”
পন্টিংদের পার্টনারশিপ ভাঙার জন্য জাহির-ইশান্ত-উমেশরা সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন। ৫১ রানে প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে পড়ার পর ধোনি ড্রেসিংরুমে ব্যতিক্রমী মিটিং ডাকেন। সেখানে ছেলেদের বলেন, “উইকেট যা আছে ঠিকঠাক জায়গায় বল ফেললে চাপ তৈরি হবেই। চলো, আমরা এই মুহূর্তটাকে ছিনিয়ে নিই। এটাই সুযোগ।” এর পরই পেসাররা পরপর উইকেট তুলতে থাকেন। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে উমেশ যাদবকে। কয়লাখনি থেকে উঠে আসা তরুণ যে গতিতে টানা বল করে যাচ্ছেন তাতে দ্রুতই না মহম্মদ নিসারকে কেউ তুলনায় নিয়ে আসে! উল্টো দিকে ইশান্ত একটা বল করলেন ঘণ্টায় ১৫২ কিলোমিটার গতিতে। ভারতীয় পেসারের সর্বোচ্চ গতির রেকর্ড। ইশান্ত ভাগ্য ফেরানোর জন্য তাঁর নামের বানানও বদলেছেন। ইশান্ত বানানে যোগ হয়েছে একটা ‘এস’, একটা ‘এন’। সবই বদলেছেন। কিন্তু ক্রিকেট ভাগ্য বদলাবে না যত দিন ব্যাটসম্যানের শরীর থেকে এত দূরে বড় বড় সুইং করান। বড় সুইং বোলার সে-ই, যে ছোট ছোট সুইং করাতে পারে। ঠিক গায়ের লাইন থেকে বলের ছোঁয়া নিয়ে যাবে। সহবাগ বলে গেলেন ঠিকই যে তাঁর দেখা এটাই ভারতের সর্বোত্তম বোলিং আক্রমণ। কিন্তু ২০০৩-এর বিশ্বকাপে জাহির-নেহরা-শ্রীনাথ ত্রিভুজের চেয়ে এটা ভাল, মেনে নেওয়া গেল না। বিশেষ করে ইশান্তের আরও ধারাবাহিকতা চাই।
চতুর্থ ইনিংসে কত রান অবধি ভারত সহজে তাড়া করতে পারে তার একটা তালিকা মুখে মুখে মিডিয়ায় ঘুরছিল। আক্রম এক রকম বলছেন। সৌরভ এক রকম বলছেন। টনি গ্রেগের আর এক রকম মনে হচ্ছে। রকমারির মধ্যেও দেখা গেল মোটামুটি মিল। ১৭৫/২০০-র পরে টিম তাড়া করতে পারবে বলে কেউ মনে করেন না। এখন সেই রানটা আরও নিরাপদ গণ্ডির বাইরে চলে যাওয়ার পর নতুন প্রশ্ন, অস্ট্রেলীয় পেসাররা নার্ভ রাখতে পারবেন পরিণত ব্যাটসম্যানশিপের বিরুদ্ধে?
ভারতীয় ব্যাটিংয়ে গৌতম গম্ভীরকে কেউ হাতে তুলছে না। অথচ তিনি যদি বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো অপ্রত্যাশিত খেলে দেন। ভিভিএস লক্ষ্মণ, যাঁর কেরিয়ার গড় ৪৭। অথচ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে গড় ৫৫ তিনি যদি স্মরণীয় চতুর্থ ইনিংসের সব পুরনো শিল্পকর্মের সঙ্গে নতুন একটা যোগ করেন। রাহুল-সচিন-সহবাগ তো থাকলেনই। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের অমর তিন স্টেশন।
আর এ বছরের মতো মেলবোর্নই ভারতীয় ক্রিকেটের শেষ স্টেশন। বছরটা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় কঠিন সিরিজ ড্র করে। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে। আবার দ্বিতীয় অর্ধে বিখ্যাত সব মানুষের মৃত্যুমিছিলের সঙ্গে যুক্ত হয় ইংল্যান্ডের বিপর্যয়। একটা যদি উৎসব হয়। আর একটা গভীর বিষাদের।
বৃহস্পতিবার এক অর্থে ভারতীয় ক্রিকেটের নিউ ইয়ার্স ইভ। ক্রিকেটবর্ষ শেষের রাত্তির। তার প্রায়াহ্নে পতাকা অর্ধনমিত থাকবে? না পতপত করে গৌরবে উড়বে সেটা ঠিক হতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা!
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস: ৩৩৩
ভারত প্রথম ইনিংস (আগের দিন ২১৪-৩)
দ্রাবিড় বো হিলফেনহস ৬৮
ইশান্ত ক হাডিন বো হিলফেনহস ১১
লক্ষ্মণ ক হাডিন বো সিডল ২
বিরাট ক হাডিন বো হিলফেনহস ১১
ধোনি ক হাসি বো হিলফেনহস ৬
অশ্বিন ক হাডিন বো সিডল ৩১
জাহির বো প্যাটিনসন ৪
উমেশ ন.আ. ২
অতিরিক্ত ৪, মোট ৯৪.১ ওভারে ২৮২।
পতন: ২২, ৯৭, ২১৪, ২১৪, ২২১, ২৩৮, ২৪৫, ২৫৪, ২৫৯।
বোলিং: প্যাটিনসন ২৩-৬-৫৫-২, হিলফেনহস ২৬-৫-৭৫-৫, সিডল ২১.১-২-৬৩-৩, লিয়ঁ ১৭-২-৬৬-০, হাসি ৫-০-১৫-০, ওয়ার্নার ২-০-৮-০।
অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংস
মোট ৬০ ওভারে ১৭৯-৮
ওয়ার্নার বো উমেশ ৫
কাওয়ান এলবিডব্লিউ উমেশ ৮
মার্শ বো উমেশ ৩
পন্টিং ক সহবাগ বো জাহির ৬০
ক্লার্ক বো ইশান্ত ১
হাসি ব্যাটিং ৭৯
হাডিন ক লক্ষ্মণ বো জাহির ৬
সিডল ক ধোনি বো উমেশ ৪
লিয়ঁ এলবিডব্লিউ অশ্বিন ০
প্যাটিনসন ব্যাটিং ৩
অতিরিক্ত ১০
পতন: ১৩, ১৬, ২৪, ২৭, ১৪২, ১৪৮, ১৬৩, ১৬৬।
বোলিং: জাহির ১৩-১-৩২-২, উমেশ ১৫-৩-৪৯-৪, ইশাম্ত ১১-০-৪১-১, অশ্বিন ১৯-৪-৪৪-১, সহবাগ ২-০-৭-০।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.