একদিন দেশ মাতবে এই গানে...
কটা নয়। দু’দুটি দুর্ঘটনা পেরিয়ে ‘বন্দে মাতরম্’ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। প্রথম দুর্ঘটনাটি ‘আনন্দমঠ’-এর কয়েক বছর আগের। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার এক কর্মী ছোট একটি কবিতা খুঁজছিলেন। কাগজে গল্প ছাপার গ্যালি প্রুফের নীচে খানিকটা সাদা জায়গা রয়ে গিয়েছে। একটি ছোট কবিতা বা গান পেলে শূন্য স্থানটি ভরাট করে দেওয়া যায়।
সম্পাদকের দেরাজ হাতড়ে পাওয়া গেল তাঁর লেখা একটি গান, ‘বন্দে মাতরম্। সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাম্।’ কর্মী জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটি ওখানে দিই?’ সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সঙ্গে সঙ্গে সেটি ছিনিয়ে নিলেন, “ও ভাবে ছাপা যাবে না। এক দিন দেখবে, দেশ এই গানে মেতে উঠেছে। সে দিন আমি থাকব না, কিন্তু তুমি দেখে যেতে পারবে।”
গ্যালি প্রুফের পদতলে নামগোত্রহীন হয়ে পড়ে থাকার ‘দুর্ঘটনা’ থেকে এ ভাবেই বেঁচে গেল ‘বন্দে মাতরম্’। কয়েক বছর পরে সম্পাদক এই বঙ্গদর্শনেই ‘আনন্দমঠ’ লিখতে শুরু করবেন, এবং সেখানে ধুয়োর মতো বারংবার ফিরে আসবে এই গান।
দ্বিতীয় ঘটনাটি এর বহু পরে। ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি। নতুন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানসভার শেষ অধিবেশন। এর আগে নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান কী হবে, ‘সেকুলার’ বা ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি লেখা থাকবে কি না, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ভোটাধিকার পাবে কি না, সে সব নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। এ দিন আর বিতর্ক নয়। সভার শেষে প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্রপ্রসাদ জানালেন, রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ হবে জাতীয় সঙ্গীত। আর স্বাধীনতাসংগ্রামে যে গান লোকের মুখে মুখে ফিরেছে, সেই ‘বন্দে মাতরম্’ও পাবে সমান মর্যাদা। চেয়ারের নির্দেশ, ফলে এই বিষয় নিয়ে কোনও বিতর্ক বা ভোটাভুটি হল না। জনগণমন এবং বন্দে মাতরম্, দুটি গান গেয়েই শেষ হল অধিবেশন। বন্দে মাতরম্ নিয়ে তার আগে তিরিশের দশক থেকে নানা বিতর্ক চলছে। সে দিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশই তাকে বিতর্ক আর ভোটাভুটি থেকে বাঁচিয়ে জাতীয় সঙ্গীত বানিয়ে দিল।
‘বন্দে মাতরম্’-এর ইতিহাস এ রকমই। ঘটনা, বাদ-প্রতিবাদ, স্লোগানের জন্ম এবং অনেক কিছু। মাঝে সুরও বদলে গিয়েছে। ১৮৮২ সালে ‘আনন্দমঠ’ প্রথম বার বই হয়ে বেরোনোর সময় গানটির নীচে পাদটীকা ছিল, ‘মল্লার রাগ। কাওয়ালি তাল।’ যদুভট্ট ওই রাগেই লেখকের ড্রয়িং রুমে গানটি গেয়েছিলেন।
রাগিণী বদলে গেল বছর তিনেক পর। ১৮৮৫ সালে ‘বালক’ পত্রিকায় তরুণ কবি ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই গানের স্বরলিপি প্রকাশ করলেন ‘দেশ’ রাগে। সুরকার লেখককে গেয়ে শুনিয়েছিলেন, লেখকের পছন্দও হয়েছিল। পরের সংস্করণেই পাদটীকায় জুড়ল: দেশ রাগ। বঙ্কিমের মৃত্যুর পর ১৮৯৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে ওই রাগেই রবীন্দ্রনাথ গানটি গেয়ে শোনাবেন। কংগ্রেস অধিবেশনে প্রথম ‘বন্দে মাতরম্’!
রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে এই গান ‘হিট’ হওয়ার পিছনে প্রযুক্তির একটি ছোট্ট ভূমিকা ছিল। স্বদেশি আন্দোলনের সময় ‘প্যাথেফোন’ রেকর্ডের বিজ্ঞাপনের বক্তব্য: নতুন প্রযুক্তিতে মনে হবে, গায়ক আপনার পাশে বসে গাইছেন। রবিবাবুর কণ্ঠে বঙ্কিমচন্দ্রের অমর ‘বন্দে মাতরম্’ শুনে দেখুন। আগের ‘এডিসন’ রেকর্ডের চেয়ে প্যাথেফোন প্রযুক্তিতে অনেকটাই এগিয়ে ছিল।
প্রশ্ন একটাই। ১৮৮৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশী আন্দোলন বহু দূরে। তা হলে রবীন্দ্রনাথ কেন ওই গানে সুর দিলেন? স্বদেশপ্রেম বা ‘দুই প্রতিভার মিলন’-টিলন বাজে কথা। রবীন্দ্রনাথ তখন উঠতি ব্যান্ডগায়কদের মতো। যে লেখা ভাল লাগে, তাতেই সুর বসান। বৈষ্ণব পদাবলীর ‘ভরা ভাদর, মাহ ভাদর’ থেকে বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘বুঝতে নারি নারী কী চায়’ সবেতেই সুর দেন। ‘বন্দে মাতরম্’-এর সুরও এই সময়েই।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর লেখা গানটি নিয়ে শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী। এই নিবন্ধের শুরুতে গ্যালি প্রুফের ঘটনাটি জানিয়েছিলেন বঙ্কিমের ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ম্যানেজার ছিলেন, তাঁর চোখের সামনে ঘটনাটি ঘটেছিল।
এই আত্মবিশ্বাসের সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস। বন্দে মাতরম গানটি সেখানে প্রায় চুম্বকের মতো, পাঁচ বার ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমে মহেন্দ্রকে সিপাইদের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনেন ভবানন্দ। অতঃপর জ্যোৎস্নারাতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি গানটি গাইছেন। শেষটা যুদ্ধক্ষেত্রে। ইংরেজ সেনা কামান দাগছে, তার মধ্যেই গান গেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সন্তানদল। উপন্যাস পড়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মৃদু অনুযোগ তুলেছিলেন, ‘সংস্কৃত আর বাংলা মেশানো এই গানে ব্যাকরণের ভুল আছে।’ আত্মবিশ্বাসী লেখকের উত্তর, ‘বেশ। ইচ্ছা হলে পড়বে, নইলে না।’
বঙ্কিম রচনাবলিতে ভবানন্দের গাওয়া প্রথম গানটি কোটেশন চিহ্নের মধ্যে। কারণ? দেরাজের কাগজে গানটি অর্ধেকই লেখা ছিল। পরে উপন্যাসে হিন্দু সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ দেখাতে গিয়ে লেখক সেটি বাড়িয়ে দেন। লেখা হয় ‘তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’ বা ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী’র মতো লাইন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ তাই গোটা গানে সুর দেননি। তিনি সুর বসিয়েছিলেন প্রথম দুটি স্তবকে। বাকিটুকু শেষ করলেন তাঁর ভাগ্নি সরলা দেবী। সরলা দেবীকে ঘিরেই ওই স্লোগানের জন্ম। আনন্দমঠ ছেপে বেরোনোর পর ইলবার্ট বিল নিয়ে আন্দোলন, আদালতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচার অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু এক বারও ‘বন্দে মাতরম্’ শোনা যায়নি। স্বদেশি আন্দোলনের সময় ময়মনসিংহের সুহৃদ সমিতি মিছিল করে সরলাকে নিয়ে গেল বক্তৃতামঞ্চে। আওয়াজ উঠল ‘বন্দে মাতরম্’। এই প্রথম!
ক্ষুদিরাম বসু এবং বিপ্লবীরা ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি তুলে ফাঁসির মঞ্চে যাচ্ছেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ‘বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়’ বলে একটি সংগঠনও তৈরি করে ফেলেছেন। গানের নামে সংগঠন দুনিয়ার কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামে বোধহয় আর নজির নেই।
ইতিমধ্যে মরাঠি, কন্নড়, গুজরাতি, তেলুগু, তামিল, হিন্দিতে বেরিয়ে গিয়েছে উপন্যাসের অনুবাদ। ১৯০৭ সালে রাজামুন্দ্রিতে লোকে মজা দেখার জন্য গরিব শিশুদের পয়সা দেয়। তারা রাস্তায় ইংরেজদের দেখলে ‘বন্দে মাতরম্’ বলে চেঁচায়, ইংরেজরা তাড়া করে। বাংলা উপন্যাস আজ অবধি একটিই সর্বভারতীয় স্লোগানের জন্ম দিয়েছে। ‘বন্দে মাতরম্’।
১৯০৭ সালে ইংরেজ প্রশাসনও হতবাক। মুখ্যসচিবকে স্বরাষ্ট্রসচিবের গোপন রিপোর্ট: ‘অশিক্ষিত জনতাকে দমিয়ে রাখতে আগে লাল পাগড়িই যথেষ্ট ছিল। এখন সে সব অতীত!’
বঙ্গভঙ্গের বছরে, ১৯০৫ সালে বারাণসীতে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্মেলন। সরলা দেবী আর লেডি অবলা বসু পাশাপাশি বসে। সভাপতি গোখলের কাছে চিরকুট গেল, সরলাকে ‘বন্দে মাতরম্’ গাইতে বলুন। নরমপন্থী গোখলে পড়লেন ফ্যাসাদে। ইতিমধ্যে বাংলার অনেক জায়গায় সেই গান নিষিদ্ধ। ফলে তিনি সরলাকে বললেন, ‘সময় কম। একটু ছেঁটে গাও।’ সরলা কি কথা শোনার বান্দা? তিনি গোটা গানটা গাইলেন। সপ্তকোটীর জায়গায় তখনকার ভারতীয় জনসংখ্যা ‘ত্রিংশ কোটি’ও গেয়ে দিলেন। সভায় হাততালি!
পরে, ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শেই গোটা গানটি নয়, প্রথম দুটি স্তবককে ‘জাতীয় সংগীত’ বলে উল্লেখ করবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি। বলা হবে, যার ইচ্ছা, সে উঠে দাঁড়াবে, গাইবে। যার ইচ্ছা নয়, গাইবে না।
মাঝের তিন দশক ধরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি মুসলিম আইডেন্টিটি উঠে এসেছে। জিন্না এবং মুসলিম লিগ প্রবল আপত্তি তুলেছে ‘বাহুতে তুমি মা শক্তি, হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি’ লেখা গানে। সুভাষচন্দ্র বসু এবং কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরু দু’জনেই রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ চেয়েছেন। তখনই ওই প্রথম দুই স্তবক গাওয়ার জন্য কবির পরামর্শ।
আর, এই পরামর্শ দিয়ে ৭৬ বছরের রবীন্দ্রনাথ তখন প্রবল আক্রমণের মুখে। প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় হস্তক্ষেপ অনুমোদন করিয়া রবীন্দ্রনাথ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন, তাহার কুফল যে শেষ পর্য্যন্ত তাঁহার উপরে আসিয়াও বর্তাইতে পারে, তিনি ভাবিয়া দেখেন নাই।’ সারা বাংলায় রবীন্দ্রবিরোধিতা, তারই মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ‘শ্রীহর্ষ’ পত্রিকায় একটি লেখা লেখেন। তরুণ কবি লিখেছিলেন, ‘কোনও দেশেরই জাতীয় সঙ্গীত কাব্যরচনা হিসাবে মহৎ নয়। বন্দে মাতরম্ও নয়।...সাহিত্যিক মূল্য শূন্য, প্রোপাগাণ্ডা মূল্য শতকরা একশো।’
বন্দে মাতরম্ ইস্যুতে রবীন্দ্রনাথ তখন প্রায় ধ্বস্ত। বুদ্ধদেব বসুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যখন জন্মেছি, তখন কটুক্তির হিল্লোল উঠলেই অনুভব করি, স্বদেশী হাওয়া সেবন করছি।’ বুদ্ধদেব উত্তরে লেখেন, ‘সমস্ত গানটা গ্রহণীয় নয়। কংগ্রেস যেটুকু ছেঁটেছেন, তার অনেক বেশি ছেঁটে ফেললেও অসুবিধা নেই।’
এই সব চিঠিপত্র আর সম্পাদকীয়ের প্রায় ৭৫ বছর পর আজ মনে হয়, বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অন্যতম দিকচিহ্ন ১৯৩৭ সালের ওই লেভেল ক্রসিং। সাংবাদিকের দৃষ্টি নয়, জিতে গিয়েছে কবির মন। শুধু ‘জাতীয় সঙ্গীত’-এর তকমা ‘বন্দে মাতরম্’কে বাঁচাতে পারত না। তাই নিজের জীবনীশক্তি পুনরাবিষ্কার করে নিয়েছে সে। কখনও লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে, কখনও বা রহমানের ‘মা তুঝে সালাম’ গানে। হাল আমলে কৌশিকী চক্রবর্তীর তারানায়, কিংবা শুভা মুদগলের ‘জয় জয় মাতরম্’ সুরে।
তিরিশের দশকে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে এ দেশের আধুনিকতম রাজনীতিক লিখেছিলেন, ‘এখন সময় খারাপ। খাঁটি সোনাকেও গিল্টি ভাবা হয়। ফলে হিন্দু-মুসলমান দুই তরফ যেখানে উপস্থিত থাকবে, সেখানে বন্দে মাতরম্ গাওয়ার ‘রিস্ক’ আমি নেব না। লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে ওই গান খোদাই করা আছে, কোনও দিন হারাবে না।’
রাজনীতিকের নাম মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.