|
|
|
|
গানটাকে আকাশের মতো ছুঁয়েছি |
‘জনগণমন’-তে আছে অনায়াস এক ভূগোল। আছে নিজের মধ্যে সেই
গানকে বহন করে দেশকে বুঝতে চাওয়ার গল্প। লিখছেন রংগন চক্রবর্তী |
যে যাই বলুন না কেন, দেশ কাকে বলে বুঝে ফেলা মোটেই অত সহজ ছিল না। বিশেষ করে আমরা যে হেতু জন্মেছিলাম উদ্বাস্তু উপনিবেশে, মানে বাংলায় যাকে বলে কলোনিতে। ছোটবেলায় যখন ‘কলোনিয়াল’, ‘পোস্ট কলোনিয়াল’ এই সব চর্চার কথা শুনতে শুরু করেছিলাম, তখন এই অশিক্ষিত মনে প্রথমেই প্রশ্ন উঠেছিল, আচ্ছা, বিদেশিদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলোনির গল্প শেষ হয়ে গেল কে বলল? কী করে তার পরেই আমরা পোস্ট কলোনিয়াল বা উত্তর উপনিবেশের বাসিন্দা হয়ে গেলাম? মানে, বিজয়গড়ের ভাষায়, ‘আরে কন কী হালায়’! তখনই তো আমাদের এই সব বিদ্যাসাগর উপনিবেশ, শ্রী কলোনি আর আদর্শ কলোনিদের জন্ম। ও পার বাংলা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে নতুন করে কলোনির জীবনযাপনে বাধ্য হল, সেই ইতিহাস কে বলবে? বোঝাই যাচ্ছে, এ সব খুব বোদ্ধার মতো কথা নয়, তাই আজকাল এই সব আর বলি না। এখন যেটা বলি সেটা অন্য কথা।
সে কথাটা হল যে, আমাদের ছোটবেলায় বিজয়গড়ে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হত, আপনার দেশ কোথায়, সবাই বলতেন ‘বরিশাল’ বা ‘ফরিদপুর’ বা ‘ঢাকা’ বা ‘নোয়াখালি’। কেউ বলতেন না ‘ভারত’। তার মানে মোটেও কিন্তু নয় যে তাঁরা ভারতবিদ্বেষী ছিলেন, বা অন্য কোনও রাজনৈতিক আনুগত্যের গল্প ছিল। আসলে দেশ মানে তখন ছিল, বাঙালরা যে কথাটা অবশ্যই কেবল মাত্র ইংরেজিতে বলবেন, ‘কান্ট্রি অরিজিন’। আশ্রয়ভূমিটা তখনও ঠিক দেশ হয়ে ওঠেনি। এই যে একটা নতুন জায়গার দেশ হয়ে ওঠা, এটা কিন্তু একটা খুব জটিল গল্প। আবার মজারও বটে। আমাদের মতো যারা স্বাধীনতার পরে এই দেশে জন্মেছিল, তাদের পক্ষে হয়তো ব্যাপারটা সহজতর ছিল। এখন জীবনের অনেকটা পেরিয়ে এসে, মনে আর পাসপোর্টে এই দেশটাকেই নিজের বলে দেখে, ভাবতে মজা লাগে যে কী করে এই বোধটা তৈরি হয়েছিল।
আর এই ভাবতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে যায় আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের কথা। খুব ছোটবেলায় লেখা শিখতে গিয়ে কিন্তু শিখতে হত যে, একটা শব্দ আর একটা শব্দের ফাঁক রেখে থেকে দূরে দূরে লিখতে হয়। তা নইলে ‘ছোটখোকাবড়বোকাখিদেপেলেকাঁদে’ টাইপের গুলিয়ে ‘গ’ কাণ্ড হবে। কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারবে না। তাই প্রথম যখন ইস্কুলে ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ পড়লাম একটু কেমন যেন গোলমেলে লেগেছিল। মানে, রবি ঠাকুর এ রকম একটা ব্যাপার করে ফেললেন, আর কেউ তো কিছু বলছে না। একটু এ দিক-উ দিক তাকিয়ে চেপে গিয়েছিলাম ভাগ্যিস। তখন আমার এখনকার মত অশিক্ষাকে ছেপে বের করে ফেলার সাহস বা সুযোগ কোনওটাই ছিল না। |
|
ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত |
যাক গে, সে তো পড়া। কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের আসল মজাটা তো ছিল সিনেমা হলে। তখন সব ছবির আগে সাদা কালো নিউজ রিল চলত। আর ছবির শেষে জাতীয় সঙ্গীত বাজত। শুধু বাজত না, তার সঙ্গে নীল আকাশে পত পত করে উড়ত দেশের পতাকা। নিউজ রিলগুলো কত রকমের যে হত। কখনও কোনও কারখানা, কখনও বা আদিবাসী নাচ। আর কী সুন্দর গলা যে হত সেই নিউজ রিলের ভাষ্যকারদের! ট্রাম ড্রাইভার হতে চাওয়ার পাশাপাশি নিউজ রিলের ভাষ্যকার হওয়াটাও তখন ‘কেরিয়ার প্ল্যানিং’-এ ছিল! এখন মনে হয়, বিজয়গড়ের একটা বাচ্চা, যার হেঁটে-চলে-দেখা-ছোঁয়া দেশের দৌড় মামার বাড়ি নেতাজিনগর পর্যন্ত ছিল, তার সামনে একটা দেশকে কিন্তু অনেকটাই তৈরি করে দিয়েছিল এই নিউজ রিল আর এই জাতীয় সঙ্গীত। এই যে এত কিছুর খবর আমাকে জানানো হচ্ছে, এর সঙ্গে আমার একটা যোগ আছে বলে, আমি এর অংশ বলে এই বোধটা কিন্তু কাজ করেছিল মনের ভেতর। নেহরুর ছবি থাকত অনেক। আমরা একটু বড় হতে হতে তিনি মারা গেলেন। লালবাহাদুরও বেশি দিন থাকলেন না। ইন্দিরা গাঁধী আসতে আসতে বিজয়গড় আর বাংলার গল্পটা অনেকটাই বদলে গেল। ষাট আর সত্তরের দশকে দক্ষিণ শহরতলির উদ্বাস্তু কলোনিতে বাঁচতে আর মরতে মরতে আমাদের অনেকেরই মনে হয়েছিল, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। কখন যেন এই নিউজ রিলও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। টের পাইনি। তার জায়গায় এল অনেক বেশি বিজ্ঞাপন।
তবে মনে থেকে গেল সেই দেশ আর ছবির শেষে সেই জাতীয় সঙ্গীত। যত দূর মনে পড়ে, বাংলা ছবি রঙিন হওয়ার আগেই ওই জাতীয় পতাকার অংশটা রঙিন হয়ে গিয়েছিল। সাদাকালো ছবি শেষ হতে হতে রঙিন পতাকা উড়তে শুরু করত। অনেকে আবার জাতীয় সঙ্গীত শুরু হওয়ার আগেই হল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো। গান শুরু হয়ে গেলে উঠে দাঁড়াতে তাদের আপত্তি, আর তাই ভয়ানক হুড়োহুড়ি। বেরিয়ে তো বিড়ি টানবে বা বাজে বকবে, কিসের এত ব্যস্ততা কে জানে! আমি কিন্তু কোনও দিন বেরিয়ে যাইনি। কোনও কোনও মানুষ থাকে, যারা হয়তো খুব দুর্বল বলে নিজের মধ্যে একটা সমষ্টির বোধ খুঁজে বেড়ায়, আমি সেই দলে। তাই হলের মধ্যে যখন সেই পতাকা উড়ত আর গানটা বাজত, নিজের মধ্যে সেই গানটাকে বহন করে আমি সেই দেশটাকে টের পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হতাম। একেবারে পাইনি তা-ও তো নয়। তবে আমার নিজের মতন করে।
আজও ঠিক জানি না আমি ভারতীয় কেন বা কীসে। কারগিল যুদ্ধ নিয়ে বাড়াবাড়ি ভাল লাগে না। কাশ্মীর দখলে রাখতেই হবে কেন জানি না। মনে হয়, দেশ ধারণাটায় বড় রক্ত আর বারুদ মিশে গেছে। যাঁরা এক রাখতে চান, আর যাঁরা বিচ্ছিন্ন রাখতে চান দুই দলের মধ্যেই। আসলে বোধ হয় আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে যে সহজ একটা এক সঙ্গে ভালবেসে থাকার গল্প আছে, র্যাফ দিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন হওয়াটাই বড় দুঃখের। এই সব ভাবি আর ভাবি কী করে এই গানটা আমার মনের মধ্যে একটা দেশকে তৈরি করে দিয়েছিল। ‘বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা, দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ’ একটা তালিকাই তো। কিন্তু এই তালিকার মধ্যে কী অনায়াস একটা ভূগোল আছে! ‘হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খ্রিস্টানি’ আবার আর এক তালিকা। কিন্তু একটা কত বড় মানবসমাজকে আমার করে তোলে। বড় হয়ে পড়ব, এই ভাবেই একটা কল্পিত গোষ্ঠী বা ইমাজিনড কমিউনিটির ধারণা তৈরি হয়। এগুলো সবই জাতি নির্মাণের কারিগরি।
বড় হব, বুড়ো হব। আস্তে আস্তে বুঝতে পারব, দেশ, জাতি, এই ধারণাগুলো খুবই বিতর্কিত। দেশ যেমন জোড়ে, তেমন বাদও দেয়। সীমান্ত ছাড়া দেশ হয় না। দেশের মধ্যেও থেকে যায় নানান সীমান্ত। আর সীমান্ত মানেই কাঁটাতার আর বেয়নেট আর রক্ত আর প্রহরী আর ধর্ষণ আর বড় কষ্ট। আমি নিজেও যে কত বার কত ভাবে উদ্বাস্তু হই। তখন বার বার মনে পড়তে থাকে সেই জাতীয় সঙ্গীত। বিজয়গড়ে বড় হয়ে ওঠা, রিকশো করে যাদবপুর আর এইট বি বাসে চড়ে সালকিয়া যেতে যেতে গড়িয়াহাট দেখেই অন্য দেশ মনে হওয়া একটা বাচ্চার মনে আরও অনেক বড় একটা কিছুর অংশ হওয়ার একটা বিপুল আহ্বান। সেই বড় হয়ে ওঠাটা আমরা পারিনি। গানটা একটা আকাশের মতো ছিল। আমরা কেউ কেউ সেই আকাশের দখল নেব, উড়ব বলে বাকিদের খাঁচায় রেখে আর ডানা মুচড়ে চলেছি। এই অপূর্ণতাই বোধ হয় ইতিহাস। |
|
|
|
|
|