সুরে ইমনকল্যাণের সহজ গীতময়তা
৯১১। বঙ্গভঙ্গরদের নির্দেশনামায় বদল হল পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ রাজধানী। কলকাতার রাজভবন ঠাঁই নিল দিল্লির দরবারে। সে সময় ২৬-২৮ ডিসেম্বর চলছিল কংগ্রেস অধিবেশন। যার দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ২৭ ডিসেম্বর শুভ সূচনায় গীত হল ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা’। কিছু দিন পরেই কলকাতার আদি ব্রাহ্মসমাজে মাঘোৎসবে গীত হয় সে গান।
বঙ্গাব্দ ১৩১৮-র (ইং ১৯১২) মাঘ মাসের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ব্রহ্মসংগীতের আখ্যায় প্রকাশ পায় ‘ভারতবিধাতা’ শিরোনামে। সেখানে সুরের উল্লেখ মেলেনি। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃত স্বরলিপিতে প্রকাশ পায় আশ্বিন, ১৩২৫-এ (ইং ১৯১৮) গীতপঞ্চাশিকায়। এই মুদ্রণ প্রকাশের আগের বছরে ১৯১৭-র ডিসেম্বরে আবারও কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনের শেষ দিনে। ২৮ তারিখে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে গীত হল সে গান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বক্তৃতায় মেলে উচ্ছ্বসিত স্বীকৃতি: ‘Brother delegates, at the very outset I desire to refer to the song to which you have just listened. It is a song of the glory and victory of India.’
গানটির পরিবেশন বিবরণী মেলে বেঙ্গলি পত্রিকায় (৩০ ডিসেম্বর ১৯১৭) ‘The congress chorus then chanted the magnificent song of sir Rabindranath Tagore, Jana-Gana-Mana — Maharaja Bahadur of Natore himself joining in aid of the instrumental music. পরদিন (৩১ ডিসেম্বর ১৯১৭) অমৃতবাজার পত্রিকাতেও সেই একই সমথর্র্ন। চতুর্মাত্রিক ছন্দে কাব্যের বুনন, সুরের ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট উল্লেখ ছিল না মুদ্রিত স্বরাকৃতিতে। তবে একটি বিচ্ছিন্ন সুর-সম্মতি মেলে ‘সিটি বুক সোসাইটি’ প্রকাশিত ‘সোনার বাংলা’ (প্র.১৯২০) সংকলন গ্রন্থে ‘মিশ্র ঠুমরি’ শীর্ষকে।


১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু আইরিশ কবি জেমস কাজিনস-এর আমন্ত্রণে অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলার মদনাপল্লিতে একটি কলেজ-এ যান। কলেজ অধ্যক্ষ কাজিনসের অনুরোধে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিলনমেলায় রবীন্দ্রনাথ জনগণমন গানটি পরিবেশন করেন বাংলাতেই। কলেজ কর্তৃপক্ষ স্থির করেন, গানটি তারা প্রার্থনা সংগীত হিসাবে ব্যবহার করবেন। অতঃপর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কলমেই অনূদিত হল সে গান THE MORNING SONG OF INDIA’। কাজিনস-বনিতা মার্গারেট এই ইংরেজি গানটার স্বরলিপি রচনা করেন। কবির তারিফ পায় সে স্বরলিপি।
উল্লেখ্য, ১৯৩৭-এ পৌত্তলিকতার অপরাধে ‘বন্দে মাতরম্’ ঘিরে সারা দেশ জুড়ে তুমূল বিতর্ক শুরু হলে ৩ নভেম্বর অধ্যাপক কাজিনস জনগণমন’-কেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে বরণ করার পক্ষে প্রস্তাব দেন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র জার্মানিতে গড়ে তোলা আজাদ হিন্দ বাহিনীতে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিলেন ‘জনগণমন’- কে। পরবর্তী কালে পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের সময়েও এই গানটিই মর্যাদা পায় জাতীয় সংগীতের। ‘জনগণমন’-র সুরবিস্তারে মূলত সা থেকে র্সা, এক সপ্তকের বুনোটে মিশ্র স্বরস্পর্শে ইমন কল্যাণের সহজ গীতময়তা। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘গানের কাগজে রাগরাগিণীর নাম নির্দেশ না-থাকাই ভাল। নামের মধ্যে তর্কের হেতু থাকে, রূপের মধ্যে না। কোন রাগিণী গাওয়া হচ্ছে বলার দরকার নেই। কী গাওয়া হচ্ছে সেটাই মুখ্য কথা। কেননা, তার সত্যতা তার নিজের মধ্যেই চরম। নামের সত্যতা দশের মুখে, সেই দশের মধ্যে মতের মিল না থাকতে পারে। কলিযুগে শুনেছি, নামেই মুক্তি। কিন্তু গান চিরকালই সত্য যুগে।’
বাহান্ন সেকেন্ডের সময়সীমায় জাতীয় সংগীতের নির্বাচনে ‘বন্দে মাতরম্’ বা সারে জাঁহা সে আচ্ছা’-র থেকে এই সহজতাই ‘অধিনায়ক’ করে দিল ‘জনগণমন’-কে।
আর সে কারণে প্রচলিত লয়ের থেকে অল্প দ্রুত হল ‘জাতীয়’ স্বীকৃতিতে।
১৯৪৪। বিমল রায় নির্দেশিত ‘উদয়ের পথে’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়ালের সংগীতায়োজনে বাজে ‘জনগণমন’। ১৫ অগস্ট ১৯৪৭। স্বাধীন হল ভারতবর্ষ। ভঙ্গ হল বঙ্গদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ভারতের জাতীয় সংগীত হিসাবে বৃন্দবাদনে পরিবেশিত হল ‘জনগণমন’। রবীন্দ্র রচনায় স্তবক সংখ্যা পাঁচ হলেও সময়সীমার কারণে খণ্ডিত আংশিকতাকেই স্বীকার করে নিল জাতীয়তার বিচারে।
হিজ মাস্টার্স ভয়েসের নিবেদনে এন ২৭৮২৯ রেকর্ডের এক দিকে সার্থক রূপদান করলেন বাংলার শ্রেষ্ঠতম শিল্পীরা। অনাদি দস্তিদারের পরিচালনায় কণ্ঠ মেলালেন জগন্ময় মিত্র, দ্বিজেন চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, নীহারবিন্দু সেন, সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়, কনক দাশ, সুপ্রীতি ঘোষ ও গীতা নাহা।
কলম্বিয়া রেকর্ডসের জি ই ৭৩৫৭ নম্বরে প্রকাশ পেল রাজেন সরকারের তত্ত্বাবধানে সুরশ্রী অর্কেস্ট্রার যন্ত্রসংগীতে ‘জনগণমন’। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের এন ৩১০৭৩ রেকর্ডে শোনা গেল ‘ভারত সরকার কর্তৃক ফরাসি দেশ হইতে নবতম সুরে পরিবর্তিত জাতীয় সংগীতের সর্বপ্রথম যন্ত্রগীতির রেকর্ড ‘জনগণমন’। অর্কেস্ট্রেশন এলিয়ান ড্যানিয়েলোর আর পরিচালনায় জে নিউম্যান।
১৯৫০, ২৪ জানুয়ারি। সরাসরি জাতীয় সংগীত হিসাবে মোহর ছাপ লাগল ‘জনগণমন’য়।
আকাশবাণী কোরাল গ্রুপের বাদ্যবৃন্দ আর কোরাসের মেলবন্ধনে গীত হয়েছে ‘জনগণমন’।
নভেম্বর ১৯৫৪। সাহানা দেবী তখন পন্ডিচেরিতে। একটা বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ‘জনগণমন’ কোরাসে সংগঠনের দায়িত্ব পেলেন শ্রীমায়ের কাছ থেকে। মূল সুরের সঙ্গে সমতা রেখে বৃন্দগান রচনা করে সবাইকে চমকে দিলেন সাহানা দেবী।
বর্তমানে একটি দেখাশোনার সিডি-তে ধৃত হয়েছে ভারতশ্রেষ্ঠ সংগীতগুণীদের টুকরো টুকরো শব্দজোড়া ‘জনগণ-ফিউশন’। সেখানে প্রত্যেকে নিজ নিজ অংশ স্বমহিম দক্ষতায় পেশ করেছেন। কিন্তু কিছু গান আছে যার সরল সাবলীলতাই তার চরিত্র। যেখানে একক কালোয়াতি বিভ্রান্তি ঘটায়, সেখানে সহজ ঐকতানই দাবি রাখে গীতময়তার।
নইলে ঘিরে ধরে শিশু শিক্ষার বয়ান ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল’।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.