আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ প্রথম বার ঠিক করে শুনেছিলাম মনে পড়ে না। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার পর যখন বড় স্কুলে ভর্তি হলাম, তখন থেকে এই গানের মর্ম কিছুটা বুঝতে পারলাম। স্কুলের প্রার্থনার শুরুতে সেই গানের পর্বে একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ সৃষ্টি হত। সবাইকে উঠে দাঁড়াতে হবে, নির্দিষ্ট কিছু ‘ডেকোরাম’ মেনে চলতে হবে। এর সঙ্গে ছিল বিস্ময়। কোথায় পঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, মারাঠা? কোথায় বা দ্রাবিড় কোথায় বা বিন্ধ্য, হিমাচল? এই গান আমার মনে সৃষ্টি করত এক বিরাটের ধারণা। যেন কোনও প্রকাণ্ড জগৎজোড়া এক প্রাণের উদ্দেশ্যে আমরা নিবেদন করতাম আমাদের সঙ্গীত। আমাদের বিদ্যালয়ের মধ্যে বেশ একটা কসমোপলিটান ব্যাপার ছিল। ফলে বিচিত্র উচ্চারণের ‘জনগণমন’ আমরা রোজই শুনতাম। তামিল ব্রাহ্মণ সন্তান আর মণিপুরের খুদে ছেলে যখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তৎসম শব্দে ভরপুর জাতীয় সঙ্গীত গাইত, হাসি চেপে রাখা দায় হত। শিক্ষকমশাইকে প্রশ্ন করেছিলাম এই সব ছোট উচ্চারণের পার্থক্যভঙ্গির বৈচিত্র্য কি আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মানহানি ঘটায় না? শিক্ষকমশাই বলেছিলেন প্রাণের যোগটাই আসল। একটু বড় হয়ে জানলাম, এই গান নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেমন জটিল প্রশ্ন উঠে এসেছে তার তুলনায় আমার প্রশ্নটি অনেক সহজ। কিন্তু এর উত্তরটি আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ।
১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম বারের জন্য গাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই সঙ্গীতটি জন্মলগ্ন থেকেই বেশ কিছু বিতর্কের মুখোমুখি। প্রথম অভিযোগ, এই গানটি সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিল্লি দরবার উপলক্ষে লেখা ও কবির ব্রিটিশ রাজভক্তির পরিচয় বহন করে। এর উত্তর কবি নিজেই দিয়েছিলেন পুলিনবিহারী সেনকে সখেদে লেখা একটি চিঠিতে। |
ইতিহাস। ১৫ অগস্ট, ১৯৪৭। কলকাতা। |
আর একটি অনুযোগ টিকে রয়েছে আরও বহু বছর ধরে। সেই মত অনুযায়ী এই গানে কেবলমাত্র ভারতবর্ষের সেই সমস্ত অংশ অর্থাৎ পঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাত ইত্যাদি প্রদেশের কথা বলা হয়েছে যেগুলি সেই সময়ে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল। স্বাধীনতার পরেও এই বিতর্ক চলেছে এবং কয়েকটি প্রদেশের কিছু মানুষ তাদের উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। বিতর্ক নিরসনে অনেক রকম ব্যাখ্যা, এবং বহু তত্ত্বকথা। অধুনা জনপ্রিয় স্যালাড বোল (Salad Bowl) তত্ত্বানুসারে ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশ, সংস্কৃতি রয়েছে একসঙ্গে, তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। কিন্তু উল্লিখিত প্রদেশগুলি একটু বেশি করে প্রকট, যে ভাবে স্যালাডের পাত্রে কিছু সবজির স্বাদ বেশি করে অনুভব করা যায়। এই সব জটিল যুক্তিজালের ভিড়ে পথ হারায় আমাদের জাতীয় সংগীতের প্রধানতম বৈশিষ্ট্যটি। আসলে, রবীন্দ্রনাথের বোধ ও বিচারকে খণ্ডিত করে দেখার ফলেই এই ভ্রম।
এই গান আসলে আমাদের এক সর্বব্যাপী ইনক্লুশন-এর দিকে নির্দেশ করে যা ভারতবর্ষের চরিত্রের এক অনন্য উপকরণ। রবীন্দ্রনাথ তার সারা জীবনের সমস্ত সাহিত্য কর্মে আমাদের দেশের এই ‘ইনক্লুসিভনেস’-এর নানা রূপ নানা ভাবে তুলে ধরেছেন। অত্যন্ত সহজ ভাবে ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘যাহা সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যাহা সকলের চেয়ে পূর্ণ, যাহা চরম সত্য, তাহা সকলকে লইয়া....’। সেই প্রেক্ষিতে এই গানের পঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাত, মরাঠা, দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গের মতো প্রদেশ কিংবা বিন্ধ্য ও হিমাচলের মতো পর্বত কেবলমাত্র একটি ভৌগোলিক এলাকা কিংবা সীমারেখা সূচিত করে না। সিন্ধু অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধ্কে চিহ্নিত করার সঙ্গে হয়তো বহু হাজার বছরের অতীত সেই গৌরবময় সভ্যতার দিকেও নির্দেশ করে। এটি আসলে ওই ‘সকলকে লইয়া’ চলার এক মহৎ ধারণা, এক শাশ্বত স্বপ্ন। সে ধারণা কাল ও স্থানের সীমারেখা সহজেই অতিক্রম করে যায়। একই ভাবে সেই স্বপ্নে ভারতবর্ষের পবিত্র নদী গঙ্গা, যমুনা আরও অনেক নদীর কথা বলে যেমন ভাবে ‘জলধিতরঙ্গ’ ভারতবর্ষের আঁচল ধুয়ে যাওয়া সব সমুদ্রের কথাই বলে। ভৌগোলিক সীমানার যে বাঁধন, তাকে অতিক্রম করে আরও বৃহৎ, আরও উদার, আরও গভীর বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে এই সমস্ত প্রদেশ, তাদের মানুষজন। এই গানেরই আর একটা স্তবক যেটি আমাদের জাতীয় সংগীতের অংশ নয় সেটিতে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক, মুসলমান, খ্রিস্টান এই সব সম্প্রদায়ের কথা যারা ‘পূরব পশ্চিম থেকে’ আসে এবং এর ফলে গাঁথা হয় ‘প্রেমহার’। এই প্রেমহারের সব ক’টি ফুল নিজ নিজ বর্ণ গন্ধ নিয়েই মালায় অবস্থান করে।
আসলে রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ কিছুই ত্যাগ করে না। গ্রহণ করে সকলকে আপন করে নেয়। ‘ভারতবর্ষ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বহু জাতি, উপজাতি, বহুভাষী অধিবাসীর বাসভূমি এই দেশের সার্থকতা হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন’ করার ক্ষমতাকে। কিন্তু এই ঐক্য স্থাপনের জন্য ভারতবর্ষ ‘বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয়’ সেগুলিকে কখনওই নষ্ট না করে ‘ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে’ অধিকার করে। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু লেখা ও বক্তৃতায় ‘নেশন’ এবং ‘ন্যাশনালিটি’-র ধারণার তীব্র সমালোচনা করেছেন। এর জন্য তিনি নিজেও কম সমালোচিত হননি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় সেই ঘটনার কথা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ, শান্তিদেব ঘোষ এবং আরও কয়েক জনকে ডেকে বলেছিলেন কেউ হয়তো জানবে না নিজের দেশকে তিনি কত ভালবেসেছিলেন আর তার পর মৃদু গলায় গেয়েছিলেন ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ গানটি।
আসলে রবীন্দ্রনাথ গভীর ভাবে অনুভব করেছিলেন যে পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা ‘নেশন’-এর ধারণা দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফেরালেও সেই শান্তি অনেকটা নঞর্থক, যা স্টিম রোলারের মতো চাপ দিয়ে সব কিছু সমান করে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এতে ‘প্রেমহার’-এর সব ক’টি ফুল সমান ভাবে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথ বার বার সাবধান করেছিলেন যে, পৃথককে জোর করে এক করলে, তাদের পার্থক্যকে যথাস্থানে বিন্যস্ত না করলে তারা এক দিন বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন হয় এবং বিচ্ছেদের সময় ঘটে প্রলয়। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষ আন্তরিক ভাবে গ্রহণের ব্যর্থতা এবং তৎপরবর্তী বিচ্ছেদের এই সব প্রলয়ের ক্ষত নিজ শরীরে বহন করে চলেছে। রামচন্দ্র গুহ রবীন্দ্রনাথের ‘Nationalism’ গ্রন্থের নতুন একটি সংস্করণের ভূমিকায় ‘Idea of India’-এর আলোচনা প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের এই ‘ইনক্লুসিভ’ সত্ত্বার কথা উল্লেখ করে মনে করিয়ে দিয়েছেন বেশ কয়েক দশক আগে করা রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণীর কথা যা এখন স্বচ্ছন্দে আল কায়দা জঙ্গিগোষ্ঠী, মাওবাদী বা উগ্র হিন্দুবাদীদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করা যায়।
বর্তমান ভারতের অনেকগুলি ব্যাধিরই কারণ হল আন্তরিক ভাবে অপরকে তার সমস্ত বৈশিষ্ট্য সমেত আপন করে নিতে পারার ব্যর্থতা। ফলে বৈচিত্র্য প্রতিভাত হয় প্রভেদে। মিলন পরিণত হয় বিচ্ছেদে, নিজ নিজ সংস্কৃতি, আদর্শ ও ধর্মীয় বিশ্বাস অন্যের ওপর আরোপের চেষ্টায় সৃষ্টি হয় বিরোধ এবং পলিটিক্স অব রিপ্রেজেন্টেশন হয় জটিলতর। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলি অসমের হোক বা কাশ্মীরের সব ক’টির সূত্রপাত গ্রহণের জায়গায় বর্জন এবং ইনক্লুশন-এর জায়গায় এক্সক্লুশন-এর নীতি ব্যবহৃত হওয়ায়। আঞ্চলিক বা সাংস্কৃতিক অস্মিতার ওপর ভর করে তৈরি হচ্ছে ক্ষোভের পুঞ্জ। সময় হয়েছে কালদর্শী সেই পুরুষের কথা শোনার, যিনি সমস্ত লেখায়, সমস্ত কর্মে শুনিয়েছেন গ্রহণের মন্ত্র, শুনিয়েছেন ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ গানেও।
তাই শুরুর প্রশ্নে ফিরে এসে বলা যায় যে সেই গান যদি বিভিন্ন প্রান্তের ভারতবাসীর বিবিধ উচ্চারণে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে মোজাইকের সহস্র খণ্ডের ছটায় নিশ্চয় আরও বেশি করে আলোকোজ্জ্বল হবে আমাদের এই দেশের ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা’। সম্ভব হবে প্রাণের নিগূঢ় যোগ। |