পর্যটক কেন আসেন? কোনও দ্রষ্টব্য দেখিবার জন্য। দ্রষ্টব্য দেখিবার জন্য কী দরকার? যথাযথ পরিকাঠামো। যে বস্তুটি যে ভাবে দেখিলে তাহা সর্বাধিক মনোগ্রাহী হয়, সেই বন্দোবস্তটি দরকার। নিশ্চয়ই পর্বতশৃঙ্গে সূর্যোদয় বা সাগরে সূর্যাস্ত দেখিবার জন্য কেহ আলো দাবি করিবেন না, কিন্তু বিষ্ণুপুরের মন্দির রাত্রিবেলা দেখিবার জন্য যথাযথ আলোকসম্পাত প্রয়োজন। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও আলো প্রয়োজন। সেই পরিকাঠামোটি নাই, অথচ ‘বিষ্ণুপুর উৎসব’ হইতেছে। পর্যটন একটি গুরুতর বিষয় নিঃসন্দেহে, কিন্তু অন্য সব ছাড়িয়া নিছক পুরাকীর্তির দিক হইতে দেখিলেও বন্দোবস্তটি দরকার। কারণ, বিষ্ণুপুর সেই বিরলতম স্থান, যাহা বাংলার নিজস্ব পুরাকীর্তির নিদর্শন বহন করে। যুক্তিটি মানিলে এই স্থানটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ন্যূনতম পরিকাঠামো দরকার। রাত্রিবেলা মন্দির-চত্বরে উপযুক্ত আলোর সংস্থান তাহারই অন্তর্গত। অর্থাৎ একটি অমূল্য পুরাকীর্তির সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাব প্রকট।
বিষ্ণুপুরের ন্যায় পুরাতাত্ত্বিক তাৎপর্যপূর্ণ একটি স্থানে যথাযথ পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য চাই যথাযথ প্রচার। জানা গিয়াছে, বহু পর্যটকই সায়ংকালে বিষ্ণুপুরের মন্দিরের শোভা দেখিতে উৎসাহী, কিন্তু আলোকাভাবে সেই উৎসাহে জল পড়ে। তাঁহারা ভগ্নচিত্তে ফিরিয়া যান। একবিংশ শতকের পর্যটন শিল্পের প্রেক্ষিতে এই ঘটনাটিকে হাস্যকর ঠেকিতে পারে। অবিশ্বাস্যও। নিপুণ আলোকসম্পাতে মন্দিরের শোভা আরও বর্ধিত করা দূরস্থান, বিনা আলোতেই মন্দিরটি পড়িয়া আছে। পর্যটন-বাণিজ্যের এমন বহুমাত্রিক বিস্তারের সময় এমন আশ্চর্য কাণ্ড কী রূপে সম্ভব, তেমন একটি বিস্ময় জাগিতেই পারে। তাহাতে বিষ্ণুপুরের মন্দিরের কিছু আসে যায় না। সূর্যাস্তের পরে তাহার ললাটে অন্ধকারই বরাদ্দ। বড়জোর চাঁদ উঠিলে কিছু আলো হইলেও হইতে পারে, তাহার অধিক কিছু নহে। বিষয়টি মজার। দ্রষ্টব্য আছে। পর্যটক আছে। নিছকই আলো নাই বলিয়া রাত্রিবেলা পর্যটকগণ অসহায়। জেলার কর্তাব্যক্তিগণও জানেন না যে, মন্দিরে আলো নাই।
এই না-জানাটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, মন্দিরে আলো নাই, এবং এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থান যে অন্ধকারে ঢাকা, সেই সংবাদ সংশ্লিষ্ট মহলে নাই, সেই জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্য দিকে, মন্দিরে যে আলো থাকা অত্যন্ত জরুরি, সেই বোধটি উচ্চতর মহলে জাগে নাই। ইহাও ভাবিবার বিষয়। যে কাজটি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়া বিচার করা উচিত ছিল, তাহা করিবার কোনও প্রয়োজনীয়তা কেহ অনুভব করেন নাই। করিতে হইবে, করিব এমন একটি ঢিমা তেতালার ভিতরেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল। এই গড়িমসির ফলে রাজ্যের পর্যটন-বন্ধু ভাবমূর্তি ঠিক কত দূর ক্ষতিগ্রস্ত হইতে পারে, সেই ধারণাটি মনের ভিতরে আসে নাই। অথচ, ঘটা করিয়া সেই স্থানেই একটি পর্যটন উৎসবের আয়োজন করা হইয়াছে। এই রাজ্যে পর্যটনের সম্ভাবনার প্রতি প্রশাসনিক মনোভাবটি ঠিক কী রূপ, পর্যটন-সংক্রান্ত পরিষেবা যথাযথ প্রদান করিবার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহ এত কাল ঠিক কোন পর্যায়ে ছিল, এই ঘটনাটি তাহারই নিদর্শন। রাজ্যে সরকার পরিবর্তন হইয়াছে। এই বিচিত্র অনাগ্রহের পরিবর্তন হইবে কি? |