গণতন্ত্র বলিতে সচরাচর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, নীতি, পদ্ধতি ইত্যাদির সম্মিলনে গঠিত ব্যবস্থাকে বোঝানো হইয়া থাকে। যথা, বহুদলীয় রাজনীতি, অবাধ নির্বাচন, সংসদের গুরুত্ব, আইনের শাসন এবং এমন আরও অনেক কিছু। ইহাদের প্রত্যেকটিই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান। বস্তুত, ভারতীয় গণতন্ত্রের যাহা কিছু শক্তি, তাহার মূলে আছে এই উপকরণগুলির সামর্থ্য, যে সামর্থ্য দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়া সৃষ্ট ও লালিত হইয়াছে। আবার সেই কারণেই, এই সব প্রতিষ্ঠান, নীতি, অনুশীলন ইত্যাদিকে লঙ্ঘন করিবার, অবজ্ঞা করিবার যে কোনও চেষ্টাই গণতন্ত্রের শক্তিক্ষয় করে। দৃষ্টান্ত: অণ্ণা হজারের আন্দোলন। কিন্তু একটি গণতন্ত্রের সাফল্য কেবল ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে না, তাহার সহিত প্রয়োজন হয় সেই ব্যবস্থার শরিক নাগরিকদের, বিশেষত তাহার চালকদের যথাযথ আচরণ। শেষ বিচারে তাহাই একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাস্থ্য ও সম্ভাবনা নির্ধারণ করিয়া দেয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ইহার একটি তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত। এই রাজ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিতে দীর্ঘ দিন ধরিয়া বহু ক্লেদ জমিয়াছে। তাহার তালিকা রচনার অবকাশ নাই, প্রয়োজনও নাই। কেবল একটি প্রাচীন ব্যাধি উল্লেখ্য, কারণ তাহার নিরাময় না হোক, প্রশমনের ঈষৎ আশা সম্প্রতি জাগিয়াছিল, কিন্তু সেই আশার প্রদীপ দ্রুত নির্বাপিত হইবার দুর্লক্ষণ অত্যন্ত প্রকট হইয়া উঠিয়াছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়া, বস্তুত তাহার আগে হইতেই, বলিয়াছিলেন, তিনি বৈরিতার রাজনীতি ছাড়িয়া সহযোগিতার রাজনীতি অভ্যাস করিবেন। বামফ্রন্ট ‘আমরা বনাম উহারা’র যে সর্বব্যাপী দ্বৈরথকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির চরিত্রে পরিণত করিয়াছিল, মুখ্যমন্ত্রীর কথায় তো বটেই, প্রাথমিক আচরণেও তাহার অবসানের বিবিধ সুসংকেত ছিল। পাড়ায় পাড়ায় বিজয়মিছিলের বাড়াবাড়ি না করা হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন প্রশ্নে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সহিত সহযোগিতা করিয়া বা তাঁহাদের মত লইয়া চলিবার চেষ্টা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রায় সম্পূর্ণ বিরল ছিল, সুতরাং নূতন জমানায় এই ধরনের প্রয়াসের নানা নজির দেখিয়া রাজ্যবাসী চমৎকৃত হইয়া ভাবিতেছিলেন, তবে কি সত্যই পরিবর্তন আসিল? সম্ভাবনাটি বিশেষ উজ্জ্বল দেখাইয়াছিল এই কারণে যে, অতীতে কেবল বামফ্রন্ট নয়, তাহার বিপরীত শিবিরেও ওই বৈরিতার বিষ পরিব্যাপ্ত ছিল, জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে ভয়ঙ্কর ‘দুর্ঘটনা’র পরে সি পি আই এমের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধীদের সরাসরি অভিযোগের ইতিহাস ছিল নিতান্ত সাম্প্রতিক ইতিহাস। প্রকৃত পরিবর্তন তো মহাকরণের অলিন্দে ঘটিতে পারে না, তাহার জন্য মনের পরিবর্তন আবশ্যক। রাজ্যবাসী ভাবিতেছিলেন, সত্যই কি রাজ্য রাজনীতির মন বদলাইল?
এই আশা, এই আকাঙ্ক্ষা, এই সুখলাঞ্ছিত বিস্ময় বিধানসভার সদ্য-সমাপ্ত অধিবেশনটির সহিত সকলই ফুরাল স্বপনপ্রায়। আমরি হাসপাতালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় অবধিও এক ধরনের সংযত সৌজন্যের দৃশ্য দেখা গিয়াছিল। কিন্তু প্রথমে বিষাক্ত চোলাই মদের ঘটনায় এবং তাহার পর ‘জলে বিষ’ সংক্রান্ত আতঙ্কের প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সভয়ে দেখিলেন, আবার সে আসিয়াছে ফিরিয়া। সেই ‘উহারা করিয়াছে’, ‘উহাদের চক্রান্ত’! আবার সেই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস কাণ্ডের পরবর্তী দোষারোপের কাহিনিই যেন পুনরাবৃত্ত। প্রত্যেকটি ঘটনাই মর্মান্তিক। প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই অপরাধী খুঁজিয়া বাহির করা প্রশাসনের এক বড় কর্তব্য, সেই প্রশাসন যে দল বা জোটেরই নিয়ন্ত্রণে থাকুক না কেন। কিন্তু সেই সকল অনুসন্ধানের তোয়াক্কা না করিয়া স্রেফ সন্দেহের বশে বা রাজনৈতিক বিরোধিতার প্ররোচনায় শাসক দলের রাজনীতিকরা যে ভাবে বিপরীত দলের প্রতি অভিযোগের তর্জনী উঁচাইয়া ধরিলেন, এমনকী ‘উহারাই জলে বিষ মিশাইয়াছে’ বলিয়া বিধানসভা মাথায় করিলেন, তাহাকে অবিশ্বাস্য বলিলে কম বলা হয়। এই মানসিকতা প্রকৃত গণতন্ত্রের চরম পরিপন্থী। আক্ষেপের কথা, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এই মানসিকতার প্রতিবাদ না করিয়া কার্যত তাহাতে ইন্ধন জোগাইয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গের কি সত্যি কোনও পরিত্রাণ নাই? |