|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
|
ইউরোপের ভুলটা ভারত করেনি বটে,
কিন্তু আমাদের ব্যর্থতাও কিছু কম নয় |
|
ইউরোপের আর্থিক সঙ্কটে আক্রান্ত দেশগুলির ধারণা, কৃচ্ছ্রসাধন করলেই তাদের সমস্যা দূর হবে।
এই ভ্রান্তিবিলাস
তাদের ক্রমশই আরও বড় সঙ্কটে ঠেলে দিচ্ছে। ভারত সেই তুলনায় বিচক্ষণতার
পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু আয়বৃদ্ধিকে
ব্যাপক সামাজিক উন্নয়নের কাজে লাগাতে আমরা মোটেই সফল হইনি। বিশ্লেষণ করেছেন
অমর্ত্য সেন |
অনেক বোর্ড গেমই ভারতে জন্ম নিয়েছিল। দাবা সম্ভবত তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত, চতুরঙ্গ বা শতরঞ্জ থেকেই এই খেলার উদ্ভব। এমনই একটি প্রাচীন ভারতীয় খেলা হল ‘সাপ এবং মই’, ভারতে যার আধুনিক রূপটি সাধারণ ভাবে ‘সাপলুডো’ নামে পরিচিত। সাপের মুখে পড়লে পতন আর মইয়ের নীচে পৌঁছতে পারলে উত্থান এ খেলা ক্রমাগত জীবনের উত্থানপতনের প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে, বলা হয়েছে, সাপলুডোর মতোই জীবনে কখনও সৌভাগ্য আসে, কখনও দুর্ভাগ্য। আর একটু এগিয়ে কর্মফলের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতেও এ খেলার দৃষ্টান্ত কাজে লাগানো হয়েছে ভাল কাজ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়, মই বেয়ে ওঠার মতো, আর মন্দ কাজ করলে সাপের মুখে পড়ে সোজা তার লেজ অবধি হড়কে যাওয়া, মানে সমুচিত ফল।
ব্রিটেনও তার উপনিবেশের এই প্রাচীন খেলাটিতে নৈতিকতার এক জব্বর প্রতীক খুঁজে পেয়েছিল। যেমন, এর অনুসরণে তারা তৈরি করেছিল একটি বোর্ড গেম, তার নাম ‘ভার্চু রিওয়ার্ডেড অ্যান্ড ভাইস পানিশড’, অর্থাৎ ‘সুকৃতি পুরস্কৃত এবং দুষ্কৃতি দণ্ডিত’। সে দেশের বহুলপ্রচলিত নীতিশিক্ষার সহজ সরল একটি ছকে বাঁধা এই খেলাটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে খুবই জনপ্রিয় হয়। সাপ এবং মইয়ের ছবি দিয়ে সাজানো এই প্রাচীন ভারতীয় খেলাটি প্রথমে ইংল্যান্ডে এবং পরে বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। যে সব গুণের পুরস্কার এবং দোষের শাস্তি মেলে, আদি খেলাটিতে সেগুলির নাম ছিল সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায়। ইংরেজি সংস্করণে তার জায়গায় এল বিলেতের সমাজে পরিচিত গুণাগুণ, দেখানো হল অনুতাপ, দয়া, আজ্ঞানুবর্তিতা এবং আত্মত্যাগের মতো গুণ মই দিয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়, আর ভ্রষ্টাচার, নিষ্ঠুরতা বা অতিশৌখিনতার বশীভূত ব্যক্তি সাপের মুখে পড়ে অতলে পতিত হয়।
কোনটি পুণ্য, কোনটি পাপ, সেই বিচার অবশ্যই সামাজিক পরিস্থিতি অনুসারে কিছুটা পালটে নেওয়া যায়। সাপ এবং মইয়ের খেলাটি উপমা হিসাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ, এ কালের নানা প্রশ্নে, এমনকী সমকালীন অর্থনীতি ও সমাজ সংক্রান্ত নীতির আলোচনাতেও এই উপমাটি ব্যবহার করা যায়। আমরা ভাবতেই পারি আমাদের এই সমস্যাসঙ্কুল দুনিয়ায় আর্থিক নীতি সম্পর্কে বিবেচনা করতে বসলে আমাদের কোন কোন ভয়ানক সাপ সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে, আবার আমাদের নাগালে কোন কোন মই আছে, যা অর্থনীতি এবং সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে? সাপলুডোর মতোই এই দুনিয়াতেও যেমন পদে পদে বড় বিপদ আছে, তেমনই আছে অনেক সুযোগ এবং সম্ভাবনাও। যে দেশগুলিকে ‘ইমার্জিং ইকনমি’ বা উদীয়মান অর্থনীতি বলা হচ্ছে, তাদের পক্ষে এই বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা কোথায় উদিত হবে সেটাই স্থির করার চেষ্টা করছে। আমরা নিশ্চয়ই এটা চাইব না যে, সাপের লেজে আমাদের উদয় হোক, আমরা বরং মইয়ের শীর্ষে আবির্ভূত হতে চাইব। সেটা কী ভাবে করা সম্ভব?
|
উন্নত দুনিয়ার সর্পকুল |
সাপ নিয়েই শুরু করা যাক। আমি এ কথা পরিষ্কার করেই বলতে চাই যে, আমার মতে, পশ্চিম দুনিয়ার অনেক দেশই এখন একটি রীতিমত অতিকায় সাপের মুখে পড়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ২০০৮ সালে যে বিপুল আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়, বিশ্ব অর্থনীতি এখনও তার কবল থেকে মুক্তি পায়নি, উদ্ধারের প্রক্রিয়াটি খুব ধীর গতিতে চালু রয়েছে। পশ্চিমের, বিশেষত ইউরোপের যে সব দেশ ধনী বলে স্বীকৃত, তাদের অধিকাংশেই এখনও বিপুল বেকারত্ব, আয়বৃদ্ধির গতি নিতান্ত ক্ষীণ, বাজারে জিনিসপত্রের চাহিদা সঙ্কুচিত। এই সব দেশে সর্বময় অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রসাধনের বিরাট সব কর্মসূচি অনুসরণ করা হচ্ছে মইয়ের থেকে শতহস্ত দূরে থাকার এবং সাপের কবলে পৌঁছনোর জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী ভাবে চেষ্টা করা যেত, তা আমার জানা নেই। এ কথা অবশ্যই সত্য যে, ইউরোপের অনেক দেশে অর্থনীতির পরিচালনায় অনেক দিন ধরেই অনেক বেশি দায়িত্ববোধ প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল। বিশেষত, বড় অঙ্কের সরকারি ব্যয়বরাদ্দ কী ভাবে ব্যবহার করা হবে, সেই বিষয়ে যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে, সরকারি কোষাগারের সদ্ব্যবহারের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী থেকে আর্থিক নীতি পরিচালনা করা উচিত ছিল। বিভিন্ন দেশের সরকার যথেষ্ট ভাল ভাবে এই দায়িত্ব পালন করেননি। কিন্তু দায়িত্বজ্ঞানহীন অপব্যয়ের বিপজ্জনক পথ থেকে সরে এসে সমস্ত সরকারি ব্যয় যথেচ্ছ ভাবে ছাঁটাই করার উদ্যোগ হলে সেটাও খুব বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখন এমন সব খাতে সরকারি ব্যয় ছাঁটাই করা হচ্ছে, যার ফলে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল এবং বিপন্ন মানুষের জীবনযাত্রার ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে, তাঁদের জীবনযাপনের নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে, এবং দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হচ্ছে। ঋণদাতাদের এবং ক্রেডিট রেটিং সংস্থাগুলিকে সন্তুষ্ট করার তাগিদে এই সম্পূর্ণ অবিবেচক ব্যয়সংকোচের ফলে আর্থিক বিপর্যয় ক্রমশই তীব্রতর হয়ে চলেছে, ইউরোপের একের পর এক দেশ তার কবলে পড়ছে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও সাপের মুখে নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়ার জন্য হাতছানি দেওয়া হচ্ছে। এই চেষ্টাকে যদি কেউ মই খোঁজার উদ্যোগ বলে ভাবেন, তা হলে বলতে হবে, এ অতি বিসদৃশ ভাবনা। সঙ্কট কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন আনার দায়িত্বশীল কর্মসূচি বলতে যা বোঝায়, এটা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। |
|
প্রতিবাদ, ডিসেম্বর ২০১১। ব্যয়সংকোচের বিরুদ্ধে, ব্রাসেলস। ছবি: এ পি। |
ঋণপত্রের (বন্ড) বাজার, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের সরকার ঘাটতি কমানোর জন্য ‘রক্ত, ঘাম এবং অশ্রু’ মোচনের পথ যে রকম উৎসাহের সঙ্গে মেনে নিয়েছে, তাতে একটা বিভ্রমের সৃষ্টি হয়েছে যে, এটাই সঙ্কটমোচনের যথাযথ পথ। সব দেশকেই এই পথে চলার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে এবং বিশেষ করে গ্রিস বা পর্তুগালের মতো বিপন্ন দেশগুলির উপর এই কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার, এতটা চরম না হলেও, একই ধরনের কৃচ্ছ্রসাধনের এক বিরাট উদ্যোগ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে। যে অর্থনৈতিক যুক্তির উপর এই নীতি দাঁড়িয়ে আছে, তা খুবই অদ্ভুত রকমের একদেশদর্শী। (মনে পড়ে, জর্জ বার্নার্ড শ’ বলেছিলেন, ইংরেজরা মনে মনে অস্বস্তি বোধ করলেই ভাবে যে, নৈতিকতার দাবি যথেষ্ট পূরণ করা হল।)
একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্য এই যে, আর্থিক বৃদ্ধির গতি বাড়লে অর্থাৎ জাতীয় উৎপাদন তথা আয় যথেষ্ট বাড়লে সরকারি রাজস্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ইউরোপ-সহ গোটা দুনিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই সত্যকে কেন উপেক্ষা করা হচ্ছে, তা বিচার করে দেখা দরকার। দ্রুত আয়বৃদ্ধিই যে সরকারি রাজস্ব বাড়ানোর সহজতম উপায়, সেটা কিন্তু চিন, ভারত বা ব্রাজিলের মতো উন্নয়নশীল দেশে যথেষ্ট স্বীকৃতি পেয়েছে। এই সব দেশে উন্নয়নের সরকারি পরিকল্পনা রচনা করতে গিয়ে এই সম্পর্ককে বরাবরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পশ্চিম দুনিয়ার সরকারি ঋণ এবং বাজেট ঘাটতি মোকাবিলার সদুপায় হিসাবেও আয়বৃদ্ধির ভূমিকা খুবই জোরদার। এ বিষয়ে ইতিহাসের শিক্ষাও বিশেষ প্রাসঙ্গিক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন শেষ হয়, তখন অনেক দেশেই সরকারের কাঁধে বিপুল ঋণের বোঝা। তা নিয়ে অনেকেরই বিরাট উদ্বেগ ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক অগ্রগতির হার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঋণের চাপ দ্রুত কমে গিয়েছিল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে বোঝাপড়ার যে উদ্যোগ চলছে, তার ফলে হয়তো দেশগুলির পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাত্রা বাড়বে। সেটা নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয়। আর্থিক সহযোগিতার পরিমাণ বাড়লে ব্যয়সংস্থানের সমূহ সঙ্কটও কিছুটা কাটতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কী ভাবে বাড়ানো যাবে তত্ত্বে নয়, বাস্তবে সে প্রশ্নের উত্তর এই উদ্যোগ থেকে খুব একটা মেলেনি। |
ভারতের খুঁজে-না-পাওয়া মইগুলি |
ভারত এবং দুনিয়ার অনেক অসচ্ছল দেশ যে চোখকান বুজে কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটেনি, সে জন্য তাদের সাধুবাদ জানাতে হবে। ভারত বেশ কিছু মইয়ের সুযোগ নিতে পারেনি বটে, (আমি এ বার সেই বিষয়েই আলোচনা করব,) কিন্তু আমরা যে সাপুড়ের মোহনবাঁশির সুরে আকৃষ্ট হয়ে তার পিছু পিছু দৌড়ইনি, সেটা অবশ্যই বিশেষ সুখের কথা।
এ বার প্রশ্ন হল, সাপ এড়িয়ে চলতে গিয়ে আমরা কোন মইগুলির সুযোগ হারাচ্ছি? প্রথমেই বলা দরকার, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জি ডি পি) বৃদ্ধির গতি যথেষ্ট বেশি হলে কেবল দেশের মানুষের আয়ই বাড়ে না, সরকারি আয়ও বাড়ে, ফলে উন্নয়নের বিশেষ সুবিধা হয়। বস্তুত, একটা দেশের জাতীয় আয় যখন দ্রুত বাড়ে, সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির হার সাধারণত তার চেয়েও অনেকটা বেশি হয়। মূল্যবৃদ্ধি বাদ দিয়ে অর্থাৎ প্রকৃত মূল্যে হিসাব করলে, কুড়ি বছর আগে ভারতে সরকারি রাজস্ব যা ছিল, এখন দাঁড়িয়েছে তার প্রায় চার গুণ। এই সময়ের মধ্যে জাতীয় আয় দ্রুত বেড়েছে বটে, কিন্তু তবু এর চেয়ে অনেক কম।
তবে, বিভিন্ন দেশে সরকারি রাজস্বের অর্থ যে ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মধ্যে অনেক তারতম্য আছে। সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে দুটি দেশের তুলনা সব সময়েই করা হয়, সেই চিন এবং ভারতের কথা ধরা যাক। ভারতের আয়বৃদ্ধির গতি এখন চিনকে প্রায় ধরে ফেলেছে, কিন্তু চিন দৃশ্যত তার আয়বৃদ্ধিকে উন্নয়নের কাজে ভারতের তুলনায় অনেক ভাল ভাবে ব্যবহার করছে। যেমন, স্বাস্থ্যের খাতে চিনের সরকারি ব্যয় ভারতের প্রায় পাঁচ গুণ। এটা ঠিকই যে, চিনের জনসংখ্যা ভারতের চেয়ে বেশি, মাথাপিছু আয়ও বেশি, কিন্তু আপেক্ষিক বিচারেও তারতম্যটা বজায় থাকে জি ডি পি’র অনুপাতে চিনে স্বাস্থ্য-ব্যয়ের মাত্রা ভারতের তুলনায় দেড় গুণেরও বেশি।
কোন খাতে কত সরকারি ব্যয় বরাদ্দ হচ্ছে, তা এমনিতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, কিন্তু তার একটা বাড়তি গুরুত্বও আছে। জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান এবং বিভিন্ন ধরনের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি একটা দেশ তার সরকার, এবং শেষ বিচারে তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা কতটা মনোযোগী, এই বিষয়গুলিকে কতটা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, সরকারি ব্যয়বরাদ্দের বিন্যাস থেকে তার একটা সঙ্কেত পাওয়া যায়। ভারতের জাতীয় আয় এখন চিনের প্রায় সমান গতিতেই বাড়ছে, অর্থাৎ আয়বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দুই দেশের অগ্রগতির ফারাক অনেক কমে এসেছে। কিন্তু দেশবাসীর গড় প্রত্যাশিত আয়ু, শিশু মৃত্যুর হার, স্কুলে পড়ার গড় সময়কাল, বিভিন্ন অসুখের প্রতিষেধক টিকার আওতায় থাকা শিশুর অনুপাত ইত্যাদি অধিকাংশ সামাজিক সূচকের মাপকাঠিতেই দু’দেশের ব্যবধান বেড়ে চলেছে। একটি দৃষ্টান্ত: চিনে এখন শতকরা ৯৭টি শিশুকে ডিপিটি’র (ডিপথিয়্রিয়া, হুপিং কাশি এবং ধনুষ্টঙ্কার) প্রতিষেধক দেওয়া হয়, ভারতে মাত্র ৬৬ শতাংশ।
তবে বিভিন্ন সামাজিক সূচকের বিচারে ভারত গত দু’দশকে, কেবল চিন নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলির, যেমন বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, এমনকী ভুটানের তুলনাতেও পিছিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ প্রায় সমস্ত সামাজিক মাপকাঠিতেই ভারতকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের সাফল্যের পিছনে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে সে দেশের অসরকারি সংগঠনগুলির (এন জি ও) জোরদার কর্মকাণ্ড। তা ছাড়া, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের কাজে বাংলাদেশের মেয়েরা যে ভাবে কাজ করছেন, ভারত তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি।
কিন্তু এ কথা বুঝতে কোনও অসুবিধা নেই যে, ওপরে ওঠার এই মইগুলি ভারতের সামনেও আছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা এবং তাঁদের সক্ষমতার প্রসার ঘটানো যদি সত্যই ভারতের লক্ষ্য হয়, তা হলে এই সুযোগগুলি কাজে লাগাতে না পারার কোনও হেতু নেই।
|
খেলায় এগিয়ে যাওয়া |
ইদানীং প্রধানত কিছু সামাজিক সূচকের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ, তবে উন্নয়নকে শুধু সেগুলি দিয়েই মাপা যায়, এমন নয়, উন্নয়ন আরও বড় ব্যাপার। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ যে ‘সহস্রাব্দের অঙ্গীকার’ গ্রহণ করেছিল, তাতে উন্নয়নের অন্য কয়েকটি দিককেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যথা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয়তো উন্নয়নের এই বৃহত্তর লক্ষ্যগুলি পূরণের কাজে বিশেষ সহায়ক হয় না, কিন্তু নীতি রচনার সময় আমাদের এই বিষয়ে বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকতে হবে যে, অন্য নানা উদ্দেশ্য সাধন করতে গিয়ে এই বৃহত্তর লক্ষ্যগুলিকে যেন অবহেলা করা না হয় বা সেগুলি পূরণের পথে বাধা সৃষ্টি করা না হয়। যেমন, ভারতে গণতন্ত্রের অনুশীলন অনেকাংশেই সফল সমাজের দরিদ্রতম বর্গের মানুষও রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে আগ্রহী এবং তৎপর। গণতন্ত্রের এই ব্যাপক চর্চাকে ভারতবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক মনে করার কোনও কারণ নেই।
এ কথা স্বীকার করে নিলে আর একটি প্রশ্ন ওঠে: এমনটা কি সম্ভব যে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ফলগুলিকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং ‘সামাজিক উন্নয়ন’-এর অন্যান্য দিকগুলির প্রসারের জন্য বাবহার করার পথে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বাধা সৃষ্টি করছে, অর্থাৎ আয়বৃদ্ধি সত্ত্বেও যে এই দেশে যথেষ্ট সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে না, গণতন্ত্রই তার জন্য দায়ী? নিউ ইয়র্ক রিভিউ পত্রিকায় লেখা এক প্রবন্ধে এই প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমি ঈষৎ স্মৃতিচর্চায় মগ্ন হয়েছিলাম। আশির দশকের আগে পর্যন্ত ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার খুব কম ছিল। সেই সময় গণতন্ত্রের সমালোচকরা এই কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন যে, গণতন্ত্র হল দ্রুত আয়বৃদ্ধির পথের কাঁটা। তখন উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে এই গণতন্ত্র-বিরোধীদের এ কথা বোঝাতে আমাদের খুবই পরিশ্রম করতে হত যে, একটা দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ কতটা অনুকূল, দ্রুত আয়বৃদ্ধি তার উপরেই নির্ভর করে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা কতটা ভয়ানক, তার উপর আয়বৃদ্ধি নির্ভর করে না। গণতন্ত্র এবং আয়বৃদ্ধির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটেছে (গণতান্ত্রিক ভারতে দ্রুত আয়বৃদ্ধির ঘটনা নিজেই তার একটা বড় কারণ), কিন্তু এখন আবার গণতন্ত্র সম্পর্কে একটা ভিন্ন সন্দেহ বা অনাস্থা ঘনিয়ে উঠেছে। সেটা এই যে, জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা এবং সামাজিক উন্নয়নের সহায়ক অন্যান্য ব্যবস্থার প্রসারে গণতান্ত্রিক শাসন বিশেষ কাজের নয়। |
|
অণ্ণা হজারের সমর্থনে, দিল্লি। ছবি: পি টি আই |
স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নায়করা যখন চান তখনই নীতি ও কার্যক্রম বদলে ফেলতে পারেন। এবং চিনের নেতাদের এই জন্য প্রশংসা করতেই হবে যে, দেশের মানুষের জীবন-মানের উন্নতি সাধনের জন্য তাঁরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্য নানা ক্ষেত্রে বিলক্ষণ জোর দিতে পেরেছেন। কিন্তু স্বৈরতন্ত্র এমন কোনও নিশ্চিতি দিতে পারে না যে, সামাজিক দায়গুলির গুরুত্ব স্বীকার করা হবেই এবং রাষ্ট্র কখনওই সেই দায় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। তা ছাড়া, একটা বহুদলীয় গণতন্ত্রে আয়বৃদ্ধিকে উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসাবে ব্যবহার করা যেতেই পারে, দুইয়ের মধ্যে কোনও সত্যকারের প্রাচীর তুলে দেওয়া নেই। কিন্তু যেটা দরকার, তা হল গণতন্ত্রের অনেক বেশি জোরদার অনুশীলন, যার মধ্য দিয়ে সামাজিক পরিসরে নাগরিকরা জাস্টিস এবং উন্নয়নের মূল দাবিগুলি আদায় করতে তৎপর হবেন। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়াল্টার বেজ’ এবং জন স্টুয়ার্ট মিল এই প্রক্রিয়াটিকে ‘আলোচনার মাধ্যমে শাসন’ (গভর্নমেন্ট বাই ডিসকাশন) নামে অভিহিত করেছিলেন। ইউরোপে কল্যাণ-রাষ্ট্রের উদ্ভবের ইতিহাস, তার উত্থানপতন সমেত, এই প্রক্রিয়ার একটি বেশ জোরদার দৃষ্টান্ত। সামাজিক পরিসরে ব্যাপক ও উন্মুক্ত যুক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে যে সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়, তার থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল এক অত্যন্ত কার্যকর কল্যাণ-রাষ্ট্রের কাঠামো, যে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে গোটা দুনিয়া শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সে ছিল ইউরোপের গৌরবের দিন (আজকের ইউরোপের ঈষৎ বিপরীত)। আয়বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের মধ্যে সেখানে একটা সামাজিক মধ্যস্থতা সক্রিয় ছিল। |
শেষ চাল, বাজিমাত? |
ভারতের কথায় ফিরে আসা যাক। এ দেশে সামাজিক বিতর্ক খুবই জোরদার, কিন্তু তার আলোচ্য বিষয়ের পরিধি সচরাচর বেশ সীমিত। ভারত এবং চিনের তুলনায় প্রধানত দু’দেশের আয়বৃদ্ধির গতির হিসাব কষা হয়ে থাকে, সেই বৃদ্ধির ফলগুলিকে সামাজিক উন্নয়নের কাজে কী ভাবে কতখানি ব্যবহার করা হচ্ছে সেই বিষয়ে আলোচনা খুব কমই হয়। এই সীমিত আলোচনার পিছনে আছে বাস্তব সমাজের একটি বিশেষ সত্য। ভারতবাসীদের একটি বড় অংশ মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বেশ কম, কিন্তু সংখ্যায় রীতিমত বিপুল আয়বৃদ্ধির প্রভূত সুফল পেয়েছেন। এই বৃদ্ধির সুফল তাঁদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনও সামাজিক মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়নি, বৃদ্ধির হার বাড়তেই তাঁরা সরাসরি তার অংশীদার হিসাবে সমৃদ্ধ হয়েছেন। এর বিপরীতে, প্রথম বর্গের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি এবং বিভিন্ন ভাবে সামাজিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত অন্য বহু ভারতীয়ের জন্য সামাজিক মধ্যস্থতা খুবই জরুরি। তাঁদের অনেকে অপুষ্টির শিকার, শিক্ষায় সম্পূর্ণ বঞ্চিত, চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সমাজ তথা রাষ্ট্র বিশেষ ভাবে সাহায্য না করলে আয়বৃদ্ধির বিশেষ কোনও সুফল তাঁদের কাছে পৌঁছবে না।
যাঁরা আয়বৃদ্ধির সুফল পেয়েছেন, তাঁদের প্রাপ্তি নিশ্চয়ই একটা অগ্রগতির পরিচায়ক, তাঁদের উন্নততর জীবন উদ্যাপনে অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু তাঁদের প্রাপ্তির উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রচারমাধ্যমের চড়া আলো তার জন্য অংশত দায়ী। এর ফলে ভারতের উন্নয়নের এমন একটা ছবি তুলে ধরা হচ্ছে, যা বাস্তবসম্মত নয়। দেশের সাধারণ মানুষের জীবন যে রকম, এই বহুলপ্রচারিত ছবিটা তার চেয়ে অনেক বেশি রঙিন। তা ছাড়া, এই প্রচার বৃহত্তর ও যথার্থ সামাজিক আলোচনার অনুকূল নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির আলোচ্য বিষয়ের তালিকাটিকে প্রসারিত করার একটা প্রবল উদ্যোগ খুবই আবশ্যক। সেই কারণেই, চিনের সঙ্গে ভারতের তুলনায় শুধুমাত্র আয়বৃদ্ধির হিসাব নিয়ে মাথা ঘামানোর অভ্যাস পরিত্যাগ করে দু’দেশের জীবনযাত্রার মানের তুলনা করাও জরুরি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, টিকাকরণ ইত্যাদির পাশাপাশি গণতন্ত্রের অনুশীলনে এবং ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুরক্ষায় কোন দেশ কেমন করছে, সেটাও গণতান্ত্রিক আলোচনার বিষয় হওয়া আবশ্যক।
ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতির চরিত্র যেমন, তাতে একটি সামাজিক ভাবনা তখনই কার্যকর হয়ে উঠতে পারে, যখন তা নিয়ে প্রচারমাধ্যমে তর্কবিতর্ক হয়, রাজনৈতিক আলোচনা চলে, সব মিলিয়ে সেটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। অনেক দেরিতে হলেও, এটা ঘটতে শুরু করেছে দুর্নীতিকে একটি বড় প্রশ্ন রূপে স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে। সমস্যা নিশ্চয়ই আছে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামর্থ্য এবং পরিধিকে প্রসারিত করে তোলার বদলে এমন পদ্ধতিতে দুর্নীতির মোকাবিলা করতে চাওয়া হচ্ছে, যা সেই ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলবে। এটা বিপজ্জনক। কিন্তু দুর্নীতির বহু পুরনো সমস্যাটির দিকে যে এখন মনোযোগ করা হচ্ছে, এই ঘটনাকে অবশ্যই স্বাগত জানানো কর্তব্য। কিন্তু সামাজিক পরিসরে বিতর্কের প্রসার ঘটা দরকার আরও অনেক বড় পরিধি জুড়ে।
|
এই মাসে দিল্লিতে প্রদত্ত এক বক্তৃতার সংক্ষেপিত রূপ |
|
|
|
|
|