‘ডনের’ দখলে গোটা শহর। হোর্ডিং-ব্যানারে তারই দাপট। ফলে নিজভূমিতে ‘তিনি’ যেন কিছুটা ব্রাত্যই। আঁতিপাতি করে খুঁজলে কিছু পোস্টার-ব্যানার চোখে পড়ে বটে। কিন্তু বান্দ্রা-কুরলা কমপ্লেক্স মাঠে (যা বিকেসি নামেই বেশি পরিচিত এবং যেখানে আগামিকাল থেকে অনশনে বসবেন ‘তিনি’) কী ভাবে পৌঁছনো যাবে, তার কোনও স্পষ্ট দিশা নির্দেশ নেই।
ভূমিপুত্র অণ্ণা হজারের অনশন নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা আগে এমনই প্রতিক্রিয়া মুম্বইয়ের।
অথচ এর মধ্যেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে, মুম্বই কি হারাতে পারবে দিল্লিকে? নিজের রাজ্যে জন-লোকপাল আইনের দাবিতে আমচি-মুম্বইকরেরা কি ছাপিয়ে যেতে পারবেন ‘আত্মকেন্দ্রিক’ শহর দিল্লিকে? অণ্ণা হজারের দুর্নীতি বিরোধী লড়াইয়ে অণ্ণার সমর্থনে দাঁড়িয়ে যে একাত্মতা দিল্লিবাসীরা দেখিয়েছিলেন, সেই গণ-উন্মাদনার সাক্ষী কি হতে পারবে দেশের বাণিজ্য রাজধানী? |
শাহরুখের ডন-টু-র হোর্ডিং-ব্যানারে ছয়লাপ শহরে মুখ লুকিয়ে থাকা অণ্ণার অনশন সেই প্রশ্ন আরও উস্কে দিচ্ছে। এ দিন দুপুরে বিকেসি-তে পৌঁছে দেখা গেল, মুষ্টিমেয় স্বেচ্ছাসেবী। তাদের ভূমিকা কী, সে বিষয়ে কোনও ধারণা নেই। ইতস্তত কয়েক জন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ, দিল্লিতে বিভিন্ন কলেজের ছাত্র-ছাত্রীকে দেখা গিয়েছিল স্বেচ্ছা শ্রম দেওয়ার তালিকায় নাম লিখিয়ে যেতে। যাদের পরে অনেকেরই দেখা মিলেছে দিল্লির বিভিন্ন মেট্রো স্টেশনে। স্টেশনের বাইরে বা টিকিট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে নিরলস তারা মানুষকে বুঝিয়ে গিয়েছে, জন-লোকপাল বিল কী এবং কেন তা হওয়া প্রয়োজন। সাধারণ মানুষকে অণ্ণার মঞ্চ পর্যন্ত টেনে আনতে ওই ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুম্বইয়ের ব্যস্ত স্টেশনগুলিতে অবশ্য এখনও তেমন কিছু চোখে পড়েনি। দিল্লির অভিজ্ঞতা বলছে, অণ্ণা অনশনে বসার অন্তত এক-দু’দিন আগে থেকেই যন্তর-মন্তর হোক বা রামলীলা ময়দান, সমর্থকদের ভিড় সামলাতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল স্বেচ্ছসেবীদের। আর এখানে বছর শেষের এই ছুটির মরসুমে বিকেসি মাঠের লাগোয়া ‘সেল’-এর কাউন্টারে বেশি মগ্ন জনতা।
অণ্ণার অনশনের মঞ্চ তৈরির কাজ দুপুরেও অর্ধেক বাকি। মাঠের যা আয়তন, তাতে গোটা তিনেক দেশপ্রিয় পার্ক অনায়াসে ঢুকে যাবে। মাঠের একপ্রান্তে মঞ্চ। যেখানে অনশন চলাকালীন বসে বা শুয়ে থাকবেন অণ্ণা। প্রয়োজনে বক্তব্য রাখবেন। মঞ্চের একপ্রান্তে অণ্ণার জন্য তৈরি করা হয়েছে শৌচাগার। অণ্ণার নিরাপত্তা ও চিকিৎসকেদের জন্য আলাদা একটি বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গোটা মাঠেই বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে রয়েছে শাল-বল্লা। তড়িঘড়ি মঞ্চ বাঁধার কাজ চলছে। ধুলো সামলাতে নাগাড়ে ছেটানো হচ্ছে জল। যার উপরে পরে পাতা হবে কার্পেট। গোটা মাঠে যত না সাধারণ মানুষ, তার থেকে বেশি ভিড় সংবাদমাধ্যমের। ভিড়ের কাছে পৌঁছাতে ক্রেনের উপর ক্যামেরা বসিয়েছে একাধিক সংবাদমাধ্যম। মাঠের চারপাশে নজরদারি টাওয়ার। গোয়েন্দা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা মাঠে।
অনশন মঞ্চে অণ্ণার উপরে হামলা হতে পারে বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বার্তা পাঠিয়েছে পৃথ্বীরাজ চহ্বাণের সরকারের কাছে। সেখানে বলা হয়েছে, হামলাকারীরা গুজরাত থেকে ট্রেনে করে আসতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকিই নিতে চাইছে না রাজ্য। বিকেসি-তে গোয়েন্দা কুকুরের টহল ছাড়াও আজ থেকেই মুম্বইয়ের বিভিন্ন স্টেশনে গুজরাত হয়ে আসা ট্রেনগুলিতে তল্লাশি চলছে। কাল থেকে মাঠে মোতায়েন থাকছে দু’হাজার পুলিশ, দু’শো সাব-ইন্সপেক্টর, ছয় প্লাটুন রাজ্য রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স, বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড ইত্যাদি। কিরণ বেদীও আজ বলেন, “নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের কোনও ক্ষোভ নেই।”
ক্ষোভ না থাক, অণ্ণা-শিবিরের আশঙ্কা থাকছেই। মুম্বই পারবে তো দিল্লির সঙ্গে টক্কর দিতে? অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা কিরণ বেদীর শরীরী ভাষায় সেটা ফুটে উঠেছে। তাই মুম্বইকরদের ‘দুর্নীতি-বিরোধী যুদ্ধে’ টেনে আনতে আজ শেষবেলায় বারবার আবেদন করতে হয়েছে কিরণ বেদীকে। সমর্থন জোটাতে একই সঙ্গে দিল্লির রামলীলা ময়দানেও অনশনে বসতে চলেছেন প্রশান্তভূষণরা। নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে ও সংখ্যালঘু সংগঠনগুলি যাতে পাশে দাঁড়ায়, সে জন্য আজ একাধিক মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাঁরা পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
নিজের রাজ্যে অণ্ণার পরীক্ষাটাকে কঠিন করে দিয়েছে কংগ্রেস সমর্থিত উত্তর ভারতীয় বিকাশ পরিষদ। অণ্ণার আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা কাল থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনশন করবে আজাদ ময়দানে। শরদ পওয়ারের দল এনসিপিও অণ্ণার প্রতিবাদে রাস্তায় নামার কথা ভেবেছে। শরদকে চপেটাঘাতের পরে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় টিভি ক্যামেরার সামনেই অণ্ণা বলেছিলেন, “একটা কেন মারল?” সেই নিয়ে এখনও ক্ষুব্ধ এনসিপি।
এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অণ্ণা কিন্তু নিজে যথেষ্ট চনমনে। দু’দিন আগেই জ্বর থেকে উঠেছেন। তাঁর এই দুর্বল শারীরিক অবস্থায় অনশন করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে কিছু মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কিন্তু সব জল্পনা উড়িয়ে চিকিৎসকরা তাঁকে ‘অনশনের উপযুক্ত’ বলে জানিয়েছেন। অণ্ণাও আজ পুণের কাছে রালেগণ সিদ্ধি থেকে মুম্বইয়ের উদ্দেশে যাত্রা করার সময় জানিয়েছেন, “অনশনে বসব ভেবেই চাঙ্গা বোধ করছি।”
কাল সকাল ৯টায় জুহুতে গাঁধী মূর্তির পাদদেশ থেকে যাত্রা শুরু করে সান্তাক্রুজ, খার, বান্দ্রা হয়ে অণ্ণার শোভাযাত্রা বেলা এগারোটা নাগাদ বিকেসি মাঠে পৌঁছবে। খোদ অণ্ণা মানুষকে ওই শোভাযাত্রায় সামিল হওয়ার অনুরোধ করেছেন। অণ্ণা শিবির মনে করছে, এক বার অনশন শুরু হলেই দলে দলে লোক আসবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ছুটির আবহাওয়ায় আপাত নিস্পৃহ আম-মুম্বইকরকে কি টেনে আনা যাবে মাঠে? বড় দিন-নতুন বছরের ছুটিতে লোকে ঘুরতে যাবে, না অণ্ণাকে দেখতে আসবে এই প্রশ্নটা করতেই ঘুরে তাকালেন ইন্ডিয়া এগেনস্ট কোরাপশন-(আইএসি)-এর প্রীতি শর্মা। বললেন, “দিল্লিতে যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখনও এই ধরনের প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। কিন্তু দিল্লি সকলকে ভুল প্রমাণ করেছে। এখানেও তাই হবে দেখে নেবেন। কারণ, দেশের যুব সমাজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করেছে।” দুপুরে সুনসান থাকলেও বিকেলে কিন্তু কিছুটা হলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোক দেখা গেল ময়দানে। সেখানে যেমন অবসরপ্রাপ্তরা রয়েছেন, তেমনই উপস্থিত ছিলেন সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কলেজ ছাত্ররাও। যুবকরা ঘুরছেন-ফিরছেন। গলা মেলাচ্ছেন দেশাত্মবোধক স্লোগানে। শপথ নিচ্ছেন গ্রেফতার বরণের। আইএসি-র তথ্য অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই গোটা দেশে এক লক্ষের বেশি লোক গ্রেফতার হবেন বলে ‘শপথ নিয়েছেন’ (যে তালিকায় কিন্তু দিল্লি অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে)। এই আবহে অণ্ণা কাল এগারোটায় বিকেসি মাঠে অনশনে বসবেন। কিন্তু দিল্লিতে মানুষ যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁর মঞ্চে ভিড় করেছিল, আজ, অনশনের ২৪ ঘণ্টা আগে বিকেসি মাঠে ছড়িয়ে থাকা ভিড় কি আগামী তিন দিনে সেই চেহারা নেবে? অনশনে বসার ঠিক আগের দিনে মুম্বইকে দেখলে সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়। |