যন্তরমন্তর থেকে শুরু হওয়া ‘সংসদ বনাম সড়ক’ লড়াই এখন তুঙ্গে।
আগামিকাল এক দিকে লোকসভায় লোকপাল বিল নিয়ে শুরু হচ্ছে আলোচনা। অন্য দিকে মুম্বইয়ে অনশনে বসছেন অণ্ণা হজারে। কিন্তু এই পর্বেই যাবতীয় বিতর্ক চুকেবুকে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম। কারণ, যে লোকপাল বিল সংসদে পেশ করেছে সরকার, তাতে অণ্ণা-শিবিরও অখুশি, আপত্তি তুলেছে বিরোধী দলগুলিও। ফলে সংসদে এই লোকপাল বিল পাশ হবে কি না, সেটাই এখন অনিশ্চিত। আর বিল পাশ হলেও তা যে অণ্ণাদের গ্রহণযোগ্য হবে না, তাঁরা যে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, সেটাও স্পষ্ট। বস্তুত, সংসদে লোকপাল বিল পেশের পরে সরকারের তরফে অণ্ণাকে ধৈর্য ধরার ‘পরামর্শ’ দেওয়া হলেও মুম্বইয়ে তিন দিন অনশনের পরে রাজধানী এসে খোদ সনিয়া গাঁধী বা রাহুলের বাড়ির সামনে ধর্নায় বসার হুমকি দিয়ে রেখেছেন তিনি। মুম্বইয়ের আন্দোলনের আঁচ যাতে দিল্লিতেও থাকে, সে জন্য আগামিকাল থেকে রামলীলা ময়দানেও ধর্নায় বসছেন অণ্ণা-সঙ্গীরা।
অণ্ণা-শিবিরের হুঙ্কারের মধ্যেই পাল্টা কড়া বার্তা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। সংসদের গরিমা কোনও ভাবেই ক্ষুণ্ণ করা হবে না, জানিয়ে তিনি বলেছেন, “অণ্ণাদের মতামত আমরা জানি। কিন্তু আইন তৈরির ভার সংসদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।” সরকারের বক্তব্য, সরকার লোকপাল বিল পেশ করেছে। আগামিকাল তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হবে। এই অবস্থায় সংসদের উপরে কোনও রকম চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়। পাশাপাশি, অণ্ণাদের আরএসএস-ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অভিযোগ আরও এক ধাপ চড়িয়ে কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ আজ বলেছেন, “গুজরাতে ১২ বছর ধরে লোকায়ুক্তর পদ খালি। অথচ অণ্ণা সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিজেপি-শাসিত কর্নাটক বা উত্তরাখণ্ডের দুর্নীতিও তার চোখে পড়ে না!”
গত সপ্তাহে লোকসভায় লোকপাল বিল পেশের সময় সাংসদেরা যে ভাবে সংসদের মর্যাদার প্রশ্নে এককাট্টা ছিলেন, তাতে গোটা লড়াইটা ‘অণ্ণা বনাম সংসদ’-এ পরিণত করতে সরকার অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। সরকার পক্ষের কড়া অবস্থানে অণ্ণারা কিছুটা হলেও কোণঠাসা। সেই সঙ্গে আদালতের সাম্প্রতিক তিরস্কারেও তাঁরা যথেষ্ট চাপে।
প্রকাশ্যে অবশ্য ‘চাপে পড়ার’ কোনও লক্ষণ দেখাতে রাজি নন অণ্ণারা। টিম-অণ্ণার সদস্য প্রশান্তভূষণ আজ বলেছেন, “গত কাল প্রধানমন্ত্রীকে লেখা খোলা চিঠিতে লোকপাল বিলে যে চারটি পরিবর্তনের দাবি তোলা হয়েছে, সেগুলি নিয়ে কোনও রকম দরকষাকষি করা হবে না। অন্য পরিবর্তনের দাবিগুলি নিয়ে আমরা পরে আন্দোলন করতে পারি।” এই চারটি দাবি হল:
• লোকপাল ও লোকায়ুক্তের নিজস্ব তদন্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। (সে ক্ষেত্রে সিবিআই সরকারের অধীনে থাকলে অণ্ণাদের আপত্তি নেই)
• তাদের স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তদন্ত করার অধিকার দিতে হবে।
• লোকপাল নিয়োগে সরকারি নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে তা নিরপেক্ষ প্যানেলের হাতে দিতে হবে। এবং
• নিচু তলার সরকারি কর্মীদের লোকপালের আওতায় আনতে হবে। এই দাবিগুলি পূরণ হতে তবেই সনিয়া বা রাহুলের বাড়ির সামনে ধর্নায় বসা থেকে তাঁরা সরে আসবেন বলে জানিয়েছেন প্রশান্ত ভূষণ।
অণ্ণাদের এই সব দাবি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির ভিন্নমত তো আছেই, (যেমন বিজেপি সিবিআই-কে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার পক্ষপাতী হলেও অনেকেই নয়) কিন্তু সংসদে সব চেয়ে বড় বিরোধের জায়গা হল সংরক্ষণ। সাংবিধানিক বৈধতা নেই বলে সংখ্যালঘু সংরক্ষণে আপত্তি রয়েছে বিজেপি-র। লোকপালের নয় সদস্যের মধ্যে কম পক্ষে পাঁচটিই সংরক্ষণের আওতায় আনাটাও সংবিধান-বিরুদ্ধ বলে বিজেপি-র মত। লালুপ্রসাদ বা বাম নেতারা আবার এ বিষয়ে বিজেপি-র সঙ্গে একমত নন। আর সরকারের যুক্তি হল, আদালতে পরে মামলা হবে ধরে নিয়ে পিছিয়ে আসা হবে কেন। সংখ্যালঘু সংরক্ষণ নিয়ে অণ্ণাদের সঙ্গেও বিরোধ লেগেছে সরকারের। অণ্ণারা আরএসএস-সমর্থনপুষ্ট বলেই তাঁরা সংখ্যালঘু সংরক্ষণের কথা বলছেন না বলে অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেস। দলের নেতা দিগ্বিজয় সিংহের বক্তব্য, “অণ্ণাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল কংগ্রেসের ক্ষতি করা ও বিজেপি-র জন্য ফায়দা তোলা।” নিজেদের ‘নিরপেক্ষ’ প্রমাণ করতে আজ মুম্বইতে উলেমা-সহ সংখ্যালঘু নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন অণ্ণা-ঘনিষ্ঠ অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাঁর বক্তব্য, সংখ্যালঘুরা অণ্ণার বিরুদ্ধে বলে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে।
শুধু সংখ্যালঘু সংরক্ষণ নয়। সিবিআই-কে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা, লোকপালের আওতায় আমলাতন্ত্রের নিচুস্তরকে রাখা, লোকপালকে অপসারণের ক্ষমতা সরকারের আয়ত্তের বাইরে রাখা, সাংসদদের বিরুদ্ধে মামলা শেষ হওয়ার আগেই স্পিকারের হাতে তাঁদের সরানোর ক্ষমতা না-দেওয়ার মতো একগুচ্ছ দাবি তুলেছে বিজেপি। লোকপাল বিলেই যে লোকায়ুক্ত গঠনের কথা বলা হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আঘাত করবে বলে বিজেপি-র সঙ্গে বাম ও আঞ্চলিক দলগুলি একমত। বামেদের প্রধান দাবি, দুর্নীতিতে জড়িত কর্পোরেট সংস্থার জন্যও শাস্তির বিধান করতে হবে। লালু প্রধানমন্ত্রীকে লোকপালের আওতায় রাখার বিরুদ্ধে।
ফলে সব মিলিয়ে সরকারের পেশ করা বিলে অসংখ্য সংশোধন আসতে চলেছে। বিজেপি-ই দু’ডজন সংশোধন চাইছে। যে সব দাবিতে বিরোধীরা এককাট্টা হবেন, সে সব ক্ষেত্রে সরকারকে মাথা নোয়াতে হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ লোকসভায় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যসভায় নেই। লোকসভায় পাশ হওয়া বিল রাজ্যসভায় আটকে গেলে যৌথ অধিবেশন ডেকে সরকারকে তা পাশ করাতে হবে।
সংসদীয় প্রতিমন্ত্রী হরিশ রাওয়াত আজ বলেন, “আমরা খোলা মনেই সব আলোচনা করব।” দেওয়া-নেওয়ার রাজনীতির পথে হেঁটে তাই সংসদে বিতর্ক চলাকালীন পর্দার আড়ালের কাজও সরকারকে এমন মসৃণ ভাবে সেরে ফেলতে হবে, যাতে লোকপাল বিল ও লোকপাল গঠনের জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল আগামী তিন দিনের মধ্যে সংসদের উভয় কক্ষেই পাশ করিয়ে নেওয়া যায়। বস্তুত আজ রাতেই তার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সরকারের শরিক ও সহযোগী দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তবে বসে নেই বিরোধীরাও। অন্য বিরোধী দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বিজেপি নেতারা। লোকপাল নিয়ে কংগ্রেস এবং বিজেপি, দুই দলই হুইপ জারি করেছে।
কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, কোনও পক্ষই লোকপাল বিল পাশের ‘প্রতিবন্ধক’ বলে চিহ্নিত হতে রাজি নয়। বিজেপি মনে করছে, লোকপাল বিল পাশ না হলে তাদের ক্ষতি নেই। কিন্তু সেই দায় তারা নিতে রাজি নয়। লালু-মুলায়মের হাঙ্গামায় বিষয়টা ভন্ডুল হয়ে গেলে বিজেপি দাবি করবে, ‘আমরা লোকপাল বিল পাশ করাতেই চেয়েছিলাম।’ বিজেপি-র মতো বামেদেরও বক্তব্য, তাঁরা লোকপাল বিল পাশ করানোর পক্ষে। কিন্তু সরকার যে বিল পেশ করেছে, তা যথেষ্ট দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ। তাই তা সংশোধন করে তাঁরা মজবুত লোকপাল গঠন করতে চাইছেন। সরকার পক্ষের বক্তব্য, লোকপাল পাশে তাদের আন্তরিকতার কোনও অভাব নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেবে সংসদই। সেই দায় তাদের নয়। |