ভিড় উপচে পড়ল মুকুটমণিপুরেও
বড়দিনে বিষ্ণুপুর-জয়চণ্ডী পাহাড়ে পর্যটকদের ঢল
হোটেল-লজে ঠাসা ভিড়, গাদাগাদি ভিড় নৌকায়। সারি সারি বাস, ছোট গাড়ি- দাঁড়িয়ে জলাধারের পাড় ও লাগোয়া এলাকায়। বড়দিন উপলক্ষে রবিবার পর্যটনকেন্দ্র মুকুটমণিপুরের চেনা ছবি ছিল এটাই। দীর্ঘদিন পরে এমন ভিড় দেখল মুকুটমণিপুর। বিপুল পর্যটক সমাগমে তাই ভারি খুশি স্থানীয় নৌকাচালক থেকে দোকানদার, হোটেল, লজ মালিকেরাও। গত কয়েক বছর ধরে পর্যটকদের সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এবার অবশ্য সেই ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে। মাওবাদী মানচিত্রে কোনদিনই মুকুটমণিপুরের নাম ছিল না। তবু রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষজন নেহাত গুজব শুনেই এখানে আসতে ভয় পাচ্ছিলেন। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। জলাধারের পাড়ে এবং লাগোয়া এলাকায় নাচগানের সঙ্গে চড়ুইভাতিতে মেতে ওঠেন পর্যটকেরা। অনেকে জলাধারে নৌকাবিহার করেন। আবার বহু পর্যটক ভুটভুটিতে চড়ে লাগোয়া বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্কে বেড়াতে যান। অনেকে পরেশনাথ মন্দিরে গিয়ে পুজোও দেন।
স্থানীয় হোটেল মালিক সুদীপ সাহু’র উচ্ছ্বাস, “অনেকদিন পরে এমন ভিড় দেখলাম। এবার প্রচুর পর্যটক এসেছেন। হোটেলের সব ঘর ‘বুকড’।” স্থানীয় নৌকাচালক রামপদ সর্দার, সুভাষ সর্দার বললেন, “জলাধারে পর্যাপ্ত জল রয়েছে। পিকনিক পার্টির লোকজন নৌকায় চেপে ঘুরছেন। ভাল রোজগার হয়েছে আমাদের।” রাস্তার ধারে ছোটদের হরেকরকম জিনিসের পসরা নিয়ে বসে থাকা মহন্ত দাস জানালেন, বিক্রিবাটা ভালোই হয়েছে। খুশি পর্যটকেরাও। বর্ধমানের নীলপুর থেকে বেড়াতে আসা মণিদীপা কর, সায়ন্তনী রায়রা বললেন, “জলাধারের পাড়ে পিকনিক করলাম। নৌকায় চড়ে বনপুকুরিয়া ডিয়ার পার্ক ঘুরে এলাম। জায়গাটা বড় সুন্দর। মন ভরে গেল। বাড়ি ফিরে সবাইকে এখানে আসতে বলব।” এভাবেই শীতের ফুরফুরে হাওয়ায়, রৌদ্রজ্জ্বল বড়দিনে পিকনিকে মাতোয়ারা মুকুটমণিপুর।
রবিবার রাসমঞ্চের ছবিটি
তুলেছেন শুভ্র মিত্র।
পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়ে পিকনিকে মেতেছেন
পর্যটকেরা। ছবি: সুজিত মাহাতো।
মেলায়, পিকনিকে এভাবেই জমজমাট বিষ্ণুপুরও। তারপর শনি-রবি পরপর দুদিনের ছুটি। একইসঙ্গে মেলা দেখা ও বিষ্ণুপুর ঘোরার টানে দুর্গাপুর থেকে এসেছেন সস্ত্রীক প্রসেনজিৎ সরকার। উঠেছেন শহরের একটি বেসরকারি লজে। রবিবার সকালে রাসমঞ্চ দেখে বলেন, “এ যেন মিশরের পিরামিড!” তাঁর স্ত্রী অর্পিতা বলেন, “মেলা থেকে কিনেছি বিষ্ণুপুরী বালুচরী, পাঁচমুড়ার ঘোড়া, শুশুনিয়ার পাথরের মূর্তি, বিকনার ডোকরার লক্ষীঝাঁপি।” বিষ্ণুপুরের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র লালগড়ে ব্যাপক ভিড় লক্ষ্য করা গেছে এ দিন। ট্যুরিস্টরা দুপুরের রোদ গায়ে মাখতে ভিড় জমিয়েছেন লালবাঁধের পাড়ে। গড়দরজা, জোড়বাংলা, মদনমোহন, মৃন্ময়ী, ছিন্নমস্তা মন্দিরেও বিশাল লাইন। দলমাদল কামান চত্বরে পোড়ামাটির দোকানগুলোতে কেনাকাটা চলেছে। মেলার মাঠে দশাবতার তাস বিক্রি করতে বসা বিদ্যুৎ ফৌজদার বললেন, “রোজ প্রায় দু হাজার টাকার তাস বিক্রি হচ্ছে। ভালো সাড়া।” পাঁচমুড়ার ঘোড়ার স্টলে শিল্পী তাপস কুম্ভকার বললেন,“তিনটি মাঠ নিয়ে মেলা বসায় কিছু অসুবিধে হচ্ছে। তবু খদ্দের পাচ্ছি ভালোই।” জমজমাট মেলা মাঠে চারটি মঞ্চ। লোকগানের শিল্পী সুভাষ চক্রবর্তী অনুষ্ঠানে গাইতে এসে বললেন, “দর্শক তো ভালোই। ঠান্ডার মধ্যেও মানুষ আসছেন।” গোপেশ্বর, রামানন্দ মঞ্চে বাউল আসরও লোকে ঠাসা। গীতাঞ্জলি মঞ্চে বিষ্ণুপুর ঘরানার গানেও অহীদাস চক্রবর্তী থেকে জগন্নাথ দাসগুপ্ত টেনে রেখেছেন উচাঙ্গ সঙ্গীতের শ্রোতাদের। তবে মেলা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গাড়ি আটকে দেওয়ায় অনেক সমস্যায় পড়েছেন। চন্দননগর থেকে আসা পর্যটক সুশীল রায় শ্যামরাই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,“একইসঙ্গে মেলা ও বিষ্ণুপুর দেখতে এসে কী বিপদে পড়লাম। এতো পথ হেঁটে ঘোরা যায়?” সমস্যার কথা মেনে নিয়ে বিষ্ণুপুরের মহকুমা শাসক তথা মেলা কমিটির সম্পাদক অদীপ কুমার রায় বলেন, “যানযট এড়াতে বৃহত্তর স্বার্থে যান নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। কিছু করার নেই।” এ দিন ছাতনার শুশুনিয়া ও শালতোড়ার বিহারীনাথ পাহাড়ে বনভোজন করতে আসা মানুষের ঢল চোখে পড়ার মত ছিল। পাহাড়ের নীচে উনুন জ্বালিয়ে কিংবা গ্যাসে রান্না হয়েছে। মানুষের ঢল দেখে স্বভাবতই মুখে হাসি ফুটেছে শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে ছোট দোকান করে বসা হস্তশিল্প ব্যবসায়ীদের। শুশুনিয়ার হস্তশিল্প ব্যবসায়ী কানু কর্মকার, মিঠু কর্মকাররা বলেন, “এ মরসুমে আজকেই সব থেকে বেশি পর্যটকদের ভিড় ছিল। এই সময়টার জন্য সারা বছর আমরা অপেক্ষা করে থাকি। এই প্রবল ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করেও এত মানুষ এসেছেন দেখে ভাল লাগছে।” খুশি বিহারীনাথ পাহাড়ের কোলে বসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। এ ব্যাপারে মহাতীর্থ বিহারীনাথ ধাম উন্নয়ন সমিতির কোষাধ্যক্ষ সুমন্ত মিশ্র বলেন, “সারা বছর পর্যটকদের দেখা না গেলেও এই সময়ে আসেন। এলাকার ব্যবসাও বাড়ে।”
অন্য দিকে, পুরুলিয়া জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলিতেও এ দিন দলে দলে চড়ুইভাতি করতে লোক জন ভিড় করেন। রঘুনাথপুর মহকুমার জয়চণ্ডী পাহাড়, পাঞ্চেত জলাধার, আদ্রার সাহেববাঁধ, আঁচুড়ির রামচন্দ্রপুর জলাধার, বেড়োর পাহাড় প্রভৃতি পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে সকাল থেকে ভিড় ছিল। জয়চণ্ডী পাহাড়ে পুরুলিয়া জেলা ছাড়াও বাঁকুড়া, বর্ধমান জেলার লোকজন বরাবর চড়ুইভাতি করতে আসেন। রেল যোগাযোগের সুবাদে পর্যটকরা সহজে এখানে পৌঁছতে পারেন। আবার পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক থেকেও জয়চণ্ডী পাহাড় দূরে নয়। এই পাহাড় ঘিরে পর্যটন উৎসব শুরু হওয়ায় সম্প্রতি পরিকাঠামোগত কিছু উন্নয়নও হয়েছে। বড়দিনে সপরিবারে এখানে চড়ুইভাতি করতে এসেছিলেন পুরুলিয়ার প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়। বাঁকুড়ার মাচানতলার বাসিন্দা অপূর্ব ঘোষ। তাঁদের কথায়, “এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। এক বেলার জন্য বেড়াতে এসে মন ভরে না।” অনেক পরিবার গাড়ি ভাড়া করে ঘুরেছেন জয়চণ্ডী ও গড়পঞ্চকোট পাহাড় এবং পাঞ্চেত জলাধার। হুড়ার পুটিয়ারি জলাধার, মানবাজারের দোলাডাঙা বা পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে কংসাবতী তীরে দূরদূরান্ত থেকে অনেকে চড়ুইভাতি করতে এসেছিলেন। বলরামপুরের সুজিত দত্ত পুটিয়ারি জলাধার দেখে বলেন, “খুব সুন্দর জায়গা।” মানবাজারের দোলাডাঙা বা ডিয়ার পার্কে ভিড় উপচে পড়েছিল। বরাবাজারের অনিমেষ মাহাতো দলবল নিয়ে দোলাজাঙায় এসেছিলেন। পুঞ্চার জৈন তীর্থ পাকবিড়রা ও কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজবাড়িতেও উৎসাহীরা এসেছিলেন। কংসাবতীর তীরে আড়শার দেউলঘাটা বা বান্দোয়ানের দুয়ারসিনিতেও এ বার ভিড় ছিল। তবে অযোধ্যা পাহাড় বা মুরগুমা জলাধারে এ বারেও বড়দিনে ভিড় নজরে আসেনি। খুব অল্প কয়েকটি দল চড়ুইভাতি করে। পাঁচ-ছয় বছর আগে এই সময়ে এখানে পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়ত।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.