লোকপাল বিলের প্রশ্নে অণ্ণা হজারের অনশন সমাবেশের জন্য সস্তায় বা বিনামূল্যে মুম্বইয়ের একটি ময়দানের ব্যবহারের আবেদনের জবাবে বম্বে হাইকোর্ট যে রায় দিয়াছে, তাহার গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। আবেদনকারীদের বক্তব্য সম্পূর্ণ খারিজ করিয়া বিচারপতিরা ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোটির মর্যাদা সুস্পষ্ট ভাষায় চিহ্নিত করিয়া দিয়াছেন। তাঁহাদের প্রশ্ন: সংসদের অধিবেশন চলিতেছে, লোকপাল বিল পেশ করা হইয়াছে, এই অবস্থায় সংসদের বাহিরে এই বিষয়ে সমাবেশ, বিক্ষোভ, বিতর্ক ইত্যাদি কি অনুমোদন করা চলে? উহা কি সংসদের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপের শামিল হইবে না? তাঁহাদের আরও বক্তব্য: এই আবেদন সম্পর্কে আদালত যদি কোনও মত দেয়, তাহাও তো হইবে সংসদের এক্তিয়ারে আদালতের হস্তক্ষেপ। আদালতের আরও একটি অভিমত: আবেদনকারীরা মনে করেন যে, প্রস্তাবিত সমাবেশটি জনস্বার্থের অনুকূল, কিন্তু অন্য অনেকেই এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন, এই দ্বিমতের মীমাংসা করা আদালতের কাজ নহে। সংসদ আছে, গণতান্ত্রিক সরকার আছে, আদালত কেন এই প্রশ্নে নাক গলাইবে? স্পষ্টতই, আদালতের বক্তব্যগুলির প্রাসঙ্গিকতা ভারতীয় গণতন্ত্রের গতিপ্রকৃতির পক্ষে বিশেষ প্রাসঙ্গিক।
ভারতীয় গণতন্ত্র, তাহার বহুবিধ সমস্যা এবং দুর্বলতা সত্ত্বেও, সজীব, সতেজ, সচল। তাহার মূল কারণ, এ দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং আচরণবিধির মান্যতা স্বাধীনতার লগ্ন হইতে, বস্তুত তাহার প্রস্তুতিপর্ব হইতেই স্বীকৃত। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং তাঁহার সহকর্মীদের অনেকেরই তত্ত্বাবধানে, তন্নিষ্ঠ অনুশীলনের মধ্য দিয়াই, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিকশিত হইয়াছে। এই প্রাতিষ্ঠানিকতাকে লঙ্ঘন না করা সুস্থ, সক্ষম গণতন্ত্রের একটি প্রাথমিক দাবি। অণ্ণা হজারে এবং তাঁহার সহমর্মীরা যখন দাবি তোলেন, তাঁহাদের ইচ্ছা অনুযায়ী লোকপাল সৃষ্টি করিতে হইবে, সংসদকে তাঁহাদের কথাই মানিতে হইবে, তখন তাঁহারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লঙ্ঘন করিবার প্ররোচনা দেন। সম্প্রতি অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এই বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। তিনি গণ-পরিসরে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলনের গুরুত্ব বা অধিকার অস্বীকার করেন নাই, কিন্তু সংসদীয় বিতর্কের মধ্য দিয়া নীতি নির্ধারণের মৌলিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়াছেন। লক্ষণীয়, বম্বে হাইকোর্টের বক্তব্যও ইহার অনুসারী। কয়েকটি শহরের কয়েকটি নির্দিষ্ট বর্গের, প্রধানত উচ্চবর্গের কিছু মানুষ ময়দানে বা রাজপথে বা অন্যত্র সমবেত হইয়া সংসদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপেক্ষা অধিক শক্তিমান হইয়া উঠিলে তাহা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ হইতে পারে না।
বম্বে হাইকোর্টের রায়ে আদালতের ভূমিকা সম্পর্কেও যে সতর্কবাণী উচ্চারিত হইয়াছে, তাহার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আদালতের কাজ আইন অনুযায়ী বিচার করা এবং, ক্ষেত্রবিশেষে, সংবিধান অনুযায়ী আইনের মূল্যায়ন করা। এ দেশে অনেক সময়েই আদালতের আচরণে সেই সীমানা অতিক্রম করিয়া শাসনবিভাগ বা আইনবিভাগের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করিবার প্রবণতা দেখা যায়। ওই বিভাগগুলির, বিশেষত প্রশাসনের অক্ষমতাই যে সাধারণত এই ধরনের হস্তক্ষেপের কারণ, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু কারণ থাকিলেও আদালতের আপন লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করা বিধেয় নহে, তাহাতে প্রশাসনের ক্ষতি হইলে সেই সমস্যা মোকাবিলার কাজটি জনসাধারণকেই ভোটের মাধ্যমে অথবা বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে সাধন করিতে হইবে, আদালত তাহার বিকল্প হইতে পারে না। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট সহ বিচারবিভাগের বিভিন্ন অলিন্দ হইতে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় সতর্কবাণী উচ্চারিত হইয়াছে। বম্বে হাইকোর্ট আবারও তাহা উচ্চারণ করিল। আশার কথা। |