জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
উত্তরপ্রদেশে সনিয়া গাঁধীর এখন প্রধান লক্ষ্য, বিজেপিকে হারাও। এই ব্যাপারে তিনি দলের নেতাদের নির্দেশিকাও পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি এবং রাহুল গাঁধী স্পষ্ট করে দিয়েছেন, মায়াবতী বা মুলায়ম সিংহ, কারও সঙ্গে সমঝোতা না করে এ বারেও দল ‘একলা চলো’র রাস্তাতেই হাঁটবে। তবে নির্বাচনোত্তর সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে মুলায়মের সঙ্গে পরোক্ষে বোঝাপড়ার পথও খোলা রাখতে বলেছেন সনিয়া।
ভোট নির্ঘণ্ট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সকলের চোখই এখন উত্তরপ্রদেশের দিকে। রাজনৈতিক ভাবে এখনও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস নেমে গিয়েছিল চতুর্থ স্থানে। এই মুহূর্তে তাদের বিধায়ক সংখ্যা ২০। বিজেপি তিন নম্বরে, এবং বিধায়ক সংখ্যায় কংগ্রেসের দ্বিগুণেরও বেশি। ৪৮। কিন্তু কংগ্রেস আশান্বিত একাধিক কারণে। একে তো ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে তারা উত্তরপ্রদেশে ভাল ফল করেছে। বিধানসভার ক্ষেত্র ধরে হিসেব করলে তারা পেয়েছে ৯৫টি আসন, যা বিজেপির থেকে অনেকটা বেশি। তার উপরে সম্প্রতি স্টার নিউজ-এসি নিয়েলসেন যে সমীক্ষা চালিয়েছে, তাতেও ইঙ্গিত, আগের থেকে তিন গুণ আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে কংগ্রেস।
এই পরিস্থিতির দিকে চোখ রেখে সনিয়া এবং রাহুল ত্রিমুখী কৌশল নিয়েছেন। প্রথমত, ভোট ঘোষণার পরে সনিয়া গাঁধী দলের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যে কোনও মূল্যে এ বারের ভোটে বিজেপিকে হারাতে হবে। উঠে আসতে হবে তৃতীয় স্থানে। দ্বিতীয়ত, এই লক্ষ্যে কংগ্রেস এ বার মায়াবতী বা মুলায়ম সিংহের সঙ্গে সরাসরি জোট না বেঁধে একলা চলারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাহুলও মনে করেন, দলের একলা চলার নীতিতে ফল ফলতে শুরু করেছে। এই ভাবেই উত্তরপ্রদেশে হৃত গৌরব ফিরে পাওয়া সম্ভব হতে পারে। তৃতীয়ত, সরাসরি জোট না করলেও মুলায়মের সঙ্গে পরোক্ষ বোঝাপড়া সেরে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন সনিয়া। রাহুল সম্প্রতি সপা প্রধানের সঙ্গে দু’বার বৈঠক করেছেন। ভোটের পরে মুলায়মের সামনে সরকার গঠনের পরিস্থিতি এলে (স্টার নিউজ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষাতেও এমনই দিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে) কংগ্রেস যাতে তাঁকে সমর্থন দিতে পারে, এই ভাবে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে।
তবে কংগ্রেস নেতৃত্ব দু’টি বিষয় মুলায়মকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। প্রথমত, অমর সিংহকে কোনও ভাবে দলে ফেরত আনা চলবে না। অমর এই মুহূর্তে পূর্ব উত্তরপ্রদেশে নিজের প্রতিপত্তি বাড়াতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছেন। তাঁর লক্ষ্য, মুলায়মের উপরে চাপ তৈরি করে দলে ফিরে আসা। কিন্তু কংগ্রেসের সাফ কথা, অমরকে কিছুতেই ফেরানো চলবে না। দ্বিতীয়ত, মুলায়ম সিংহকেই মুখ্যমন্ত্রী হতে হবে। তাঁর পুত্র অখিলেশকে ওই পদে মেনে নেবে না কংগ্রেস।
উত্তরপ্রদেশের ভোটে কংগ্রেসের এ ভাবে আটঘাট বেঁধে নামার পিছনে বড় কারণ, সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের পুরভোটে তাদের ভাল ফল। দীর্ঘদিন সে রাজ্যে এনসিপি-র সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বিজেপি-শিবসেনা জোটকে তারা পর্যুদস্ত করেছে। এই জয়ে কংগ্রেসের মনোবল বেড়েছে। হরিয়ানাতে একটি উপনির্বাচনে অণ্ণা হজারে দলবল নিয়ে প্রচার করে কংগ্রেস প্রার্থীকে হারিয়ে দিলেও অন্য উপনির্বাচনে তারা জয় পেয়েছে। ভোটও বেড়েছে। এর অর্থ, হরিয়ানার ভোটে অণ্ণার কিছুটা প্রভাব পড়লেও মহারাষ্ট্রে, অর্থাৎ অণ্ণার নিজের রাজ্যেই তাঁর কোনও প্রভাব পড়েনি।
ইউপিএ-২ সরকারের আড়াই বছর কেটে যাওয়ার পর পরিস্থিতিটা কিন্তু কোনও ভাবেই মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধীর অনুকূলে নয়। তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন, নানাবিধ প্রশাসনিক ব্যর্থতার মুখে পড়ছে সরকার। শিল্পপতিরা পর্যন্ত বলছেন, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সরকার। মনমোহন তাঁদের বলেছেন, শরিকদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসেরই কোনও কোনও নেতা বলছেন, ইউপিএ-১-এর থেকেও এই পর্বে সরকারের সমস্যা অনেক বেশি। মনমোহন-সনিয়ার মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব আগে এতটা স্পষ্ট হয়নি। এ সবের ফলে যে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ধাক্কা খেয়েছে এবং মনমোহনের কর্তৃত্ব দুর্বল হয়েছে, সেটা ঘরোয়া ভাবে অনেকেই মেনে নিচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে সনিয়া-রাহুল চাইছেন, উত্তরপ্রদেশের ভোটে ভাল ফল করে দেখাতে। সমীক্ষার ইঙ্গিত তো আছেই, তা ছাড়া সনিয়া-মনমোহন এটা ভাল ভাবেই বুঝেছেন, ইউপিএ সরকারের দুর্বল অবস্থাকে কাজে লাগাতে পারেনি প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। তারা কোন্দল থামিয়ে নিজেদের ঘর গোছাতে ব্যর্থ। তাদের মধ্যে নেতৃত্বের সঙ্কটও যথেষ্টই তীব্র। এমনকী, উত্তরপ্রদেশে একাধিক নেতা নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত চুলোচুলি করে চলেছেন।
এই অবস্থাকে কাজে লাগাতে সনিয়া-রাহুলের কৌশল, মায়াবতীকে হারানোর থেকেও বেশি করে কোণঠাসা করো বিজেপিকে। তাদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দাও, যাতে তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে না পারে। উত্তরাখণ্ডেও বিজেপির অবস্থা খারাপ। সেখানে পরিস্থিতি এতটাই আশঙ্কাজনক যে, ভোটের মাত্র কয়েক মাস আগে দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত রমেশ পোখরিয়ালকে সরিয়ে বি সি খান্ডুরিকে ফের মুখ্যমন্ত্রী করতে হয়। সৎ ভাবমূর্তি থাকা সত্ত্বেও এত কম সময়ে খান্ডুরি কিছু করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই কংগ্রেস মনে করছে, রাহুল সেখানে গিয়ে প্রচার করলে জোর ধাক্কা দেওয়া যাবে বিজেপি সরকারকে। পঞ্জাবেও বিজেপি-অকালি জোট সরকারের অবস্থা ভাল নয়। সেখানেও জোরদার প্রচারে ভাল ফল করার আশা রাখছে কংগ্রেস। বাকি দুই রাজ্য, মণিপুর এবং গোয়া নিয়ে অবশ্য কংগ্রেস নেতৃত্ব ততটা ভাবিত নন।
এখন প্রশ্ন, ৪ মার্চ, পাঁচ রাজ্যের ভোট গোনার দিন জনমত যদি কংগ্রেসের অনুকূলে যায়, তা হলে জাতীয় ক্ষেত্রে তার কী প্রভাব পড়বে?
দলীয় নেতারা মনে করছেন, তা হলে আড়াই বছরের গ্লানি ঝেড়ে ফেলে মনোবল অনেকটাই বাড়িয়ে নিতে পারবে দল। সেই সময় বাজেট অধিবেশন চলবে। বস্তুত, এখনও যা ইঙ্গিত, তাতে ভোটের ফল প্রকাশের পরে বাজেট পেশ হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। সেই সময় এই জয়কে মূলধন করে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবে কংগ্রেস।
কিন্তু বিজেপির কী হবে? বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও বুঝতে পারছেন, তাঁরা এই মুহূর্তে কতটা অসহায়। কারণ, উত্তরপ্রদেশে তো তাঁদের নেতার সংখ্যা অনেক। লালজি টন্ডন, কলরাজ মিশ্র, কেশরীনাথ ত্রিপাঠি, রাজনাথ সিংহ, বিনয় কাটিয়ার, কল্যাণ সিংহ, মুরলীমনোহর জোশী সকলেই নিজেদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাবশালী এবং নিজেদের জোর খাটাতে ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা এতটাই যে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথ যখন উত্তরপ্রদেশে ঢুকেছিল, তখন তাঁকেও আসতে বারণ করেছিলেন তাঁরা। কোনও রকমে দু’একটি জায়গা ছুঁয়ে আডবাণী কার্যত উত্তরপ্রদেশকে এড়িয়েই গিয়েছিলেন সে যাত্রায়। রাজ্যে এই কলহ সামলাতে বিজেপির প্রভারী, সঙ্ঘের ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় জোশী এখন জেরবার। শেষ পর্যন্ত উমা ভারতীকে সামনে নিয়ে এসেছেন দলীয় নেতৃত্ব। কারণ, উমা অনগ্রসর শ্রেণি এবং মহিলা। তাই তিনি দলিত নেত্রী মায়াকে বেগ দিতে পারবেন। কিন্তু এর মধ্যে উমার পিছনে লেগে গিয়েছেন ওই নেতারা। গোলমাল পাকিয়েছে বরুণ গাঁধীকে নিয়েও। তাঁর উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তৃতার অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে তাঁকে রাজ্যে ডাকতে নারাজ দলের একাংশ। এতে বরুণের গোঁসা হয়েছে। দলের এক শীর্ষ নেতা তাই বলে ফেলেছেন, “এই সব নেতার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে সকলকে আন্দামানে পাঠিয়ে দিতে পারলে দল ভাল ফল করত!” কেন্দ্রের নেতারাও প্রচারে যেতে চাইছেন না। খুব বড় আশাবাদীও মনে করছেন না, বিজেপি তৃতীয় স্থানটি ধরে রাখতে পারবে। একমাত্র আশা, যদি ব্রাহ্মণরা এ বার মায়াবতীকে ছেড়ে তাঁদের দিকে আসে!
এই পরিস্থিতির কথা ভেবে রাহুলও এগোচ্ছেন। বস্তুত, কংগ্রেস বরাবরই সব ধর্ম, জাতপাতের দল। তাই এ বার ব্রাহ্মণরা মায়াকে ছাড়লে তাদের দিকেই যাতে আসে, সেই চেষ্টারও ত্রুটি রাখছেন না কংগ্রেস নেতৃত্ব। মুলায়মের সঙ্গে তাই প্রকাশ্যে জোটে যাচ্ছেন না তাঁরা। বরং গাঁধী পরিবারের ভিত্তিভূমি উত্তরপ্রদেশে নেহরু-ইন্দিরার পথ ধরে বহুত্ববাদী মডেলেই এগোতে চাইছেন সনিয়া-রাহুল। তাই নেহরুর কেন্দ্র থেকে প্রচারে গিয়েছেন রাহুল। জানুয়ারিতে সপ্তাহব্যাপী টানা প্রচার চালাবেন বলেও ঠিক করে ফেলেছেন তিনি।
এই কৌশলে এগিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব সফল হবেন কি না, সেটা অবশ্য ৪ মার্চই জানা যাবে। |