শহরে ‘পেপসি’। গ্রামে ‘ঢোলফোলা’।
কালনার হাটে-বাজারে চোলাইয়ের দুই পরিচিত নাম। দাঁতনকাঠিতলা, শীতলাতলা, রাজীব গাঁধী মোড়-সহ কালনা শহরের বিভিন্ন এলাকায় গেলে চোলাইয়ের ঠেক চিনিয়ে দিতে পারেন যে কেউ-ই। খরিদ্দারের দেখা মিলতেই ঠেক-মালিকেরা তাঁদের নিয়ে চলে যাচ্ছেন গোপন ডেরায়। চোলাই খেতে খেতে ক্রেতারা হাত বাড়াচ্ছেন সিদ্ধ ছোলার বাটির দিকে।
ক্রেতাদের বেশিরভাগই ভ্যানচালক, রিকশাচালক অথবা খেতমজুর। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, অনেকেই দিন পাঁচ-ছ’বার করে ঠেকে যান। অনেকে আবার ঠেক ছাড়ার আগে কিনে নিয়ে যান প্যাকেটে মোড়া চোলাই। এই সব চোলাইয়ের দাম পাঁচ থেকে কুড়ি টাকা পর্যন্ত।
কালনা শহর সংলগ্ন ভাগীরথী নদীর ধারে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ইঁটভাটা। সারা বছরই ঝাড়খণ্ড, বিহার-সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিকেরা আসেন। ওই সব ইঁটভাটাগুলিতে দীর্ঘ দিন ধরেই রমরমা চোলাইয়ের। সন্ধ্যা নামলেই ব্যাগভর্তি চোলাইয়ের প্যাকেট সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়ে যান কারবারিরা। মুহূর্তের মধ্যেই খালি হয়ে যায় ব্যাগ। ভাটাগুলির নিয়মানুযায়ী, প্রত্যেক বুধবার ‘হপ্তা প্রথা’ রয়েছে। এ দিন সারা সপ্তাহের রোজগারের অর্ধেক টাকা শ্রমিকদের দিয়ে দেওয়া হয়। স্বভাবতই সে দিন চোলাইয়ের বিক্র্রিও যায় বেড়ে। তবে কোনও শ্রমিক চোলাই খাওয়ার সময় টাকা দিতে না পারলে তার জন্য থাকে ‘ধারের খাতা’। কালনা শহরের এক ইঁটভাটা মালিকের দাবি, “বাড়ি ফেরার আগে সব শ্রমিকদের বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হয়। আর সেই টাকার জন্য অপেক্ষায় থাকে চোলাই কারবারিরা। ভাটি থেকে বেরোনো মাত্রই তাঁদের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া হয় বকেয়া। আর এই সব কারবারিদের দৌরাত্ম্যে অনেক শ্রমিককেই খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়।” |
শহরে এই চোলাই বা ‘পেপসি’ আসে কোথা থেকে? খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, চোলাই তৈরি হয় ডুমুরদহ, কুন্তিহাট, ত্রিবেণী-সহ হুগলি জেলার বিভিন্ন জায়গায়। ভাটি থেকে চোলাই সংগ্রহ করে বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেন ‘ম্যাসেঞ্জার’রা। চোলাই ভর্তি ‘জার’ তারা দিয়ে আসেন চোলাই কারবারিদের কাছে। ন্যূনতম তিনটে ‘জার’ মালিকের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে ম্যাসেঞ্জারদের মজুরি মেলে ১৮০ টাকা।
গ্রামাঞ্চলে চোলাইয়ের নাম ঢোলফোলা। বৃদ্ধপাড়া, গ্রামকালনা, ধাত্রীগ্রাম-সহ কালনার বিভিন্ন গ্রামে চলে ঢোলফালার অবৈধ কারবার। বৃদ্ধপাড়ার বাসিন্দা নিমাই সর্দারের অভিযোগ, “প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণেই চোলাইয়ের কারবার বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি গ্রামের মহিলারা কয়েকটি অবৈধ ভাটি ভেঙে দিলেও লুকিয়ে চুরিয়ে এই ব্যবসা চলছে।”
মন্তেশ্বরের আসুরি গ্রামের তৃণমূল নেতা বিনয় ঘোষের দাবি, “গত দু’বছরে বিষমদ খেয়ে আশপাশের এলাকায় অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তা সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি এই কারবার।”
আবগারি দফতরের কালনা শাখার ওসি বিষ্ণুপদ রায় বলেন, “কালনা মহকুমায় পূর্বস্থলীতে চোলাইয়ের কারবার সবথেকে বেশি। তাই অন্য জায়গায় তুলনায় ওখানে বেশি অভিযান চালানো হয়।”
অভিযানেই অভাবেই কি চোলাইয়ের এত রমরমা? তার অবশ্য কোনও সদুত্তর মেলেনি। |