ব্যাগি গ্রিন-তেরঙ্গা দ্বৈরথে মেলবোর্নের বড়দিনের সুর

চিন মিউজিক
‘বলিলাইন’ মহাবিতর্কের পুনঃসূচনা
আগাম গরগরে অস্ট্রেলীয় আস্ফালন যে, জিতছিই
খেলোয়াড়সুলভ স্পিরিট রফা
অস্ট্রেলিয়ার কেউ অবাধ্য হলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা
দু’দলে বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকা

শান্তির বাণী বয়ে আনা অবিকল এমন মনোভাবধর্মী মাইকেল ক্লার্কের সাংবাদিক সম্মেলন শনিবার দুপুরে শেষ হওয়া মাত্র গরগরে রাগে ফেটে পড়লেন দুই সিনিয়র অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক। এত প্রকাশ্য ছিল এঁদের প্রতিক্রিয়া যে, অপসৃয়মান ক্লার্কের কানে যদি খানিক গিয়ে থাকে আশ্চর্যের নয়। “কী অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন হয়েছিস তুই! এমন মিনমিনে প্রি সিরিজ প্রেস কনফারেন্স করে গেলি। কী কথাবার্তাগুলো বললি একবার নিজে ভেবে দেখেছিস!”
জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, চার বছর আগের অভিশপ্ত ‘বলিলাইন’ সিরিজ যাতে ফিরে না আসে, তার জন্য কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন? উত্তরে ক্লার্ক যা বললেন, এই গোলার্ধে ক্রিসমাস ইভের অন্যতম বিস্ময়কর ঘটনা!
“সেই বৈরিতা কিছুতেই ফিরতে দেব না। আমাদের দু’টো টিমের মধ্যে অধুনা যা সম্পর্ক অতীতে কখনও এত ভাল ছিল না। সে বারের তুমুল গণ্ডগোলের পরপর আইপিএলে একে অন্যের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করে সব মিটমাট হয়ে যায়। এখন একে অপরকে অনেক ভাল বোঝে। আর এই স্পিরিটটাকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের দিক থেকে ঠিক করে রেখেছি, কোনও প্লেয়ার যদি বাড়াবাড়ি করে, তাকে কড়া শাস্তি দেব। আইসিসি কী শাস্তি দেয় তার জন্য আমরা বসে থাকব না। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া নিজে থেকে কড়া শাস্তি দেবে। আমার টিমে লাইনের ও পারে কেউ গিয়েছে কী সে মরেছে।”
ইয়ান চ্যাপেল। স্টিভ ওয়। বা শেন ওয়ার্ন। এঁদের একজনও সেই জমায়েতে থাকলে সম্মেলনের পরের অংশটাও নিশ্চয়ই একই রকম জমজমাট হত। কিন্তু পারিবারিক এই ছুটি কাটানোর দিনে এঁরা আর এমসিজি-তে কী করতে থাকবেন। স্বদেশীয় সাংবাদিকদের এক অংশ বিহ্বল, আর এক অংশকে উত্তেজিত করে দিয়ে ক্লার্ক তাই বেরিয়ে গেলেন। উত্তেজিত সাংবাদিকদ্বয় অবশ্য বলতেই থাকলেন, “ভাবমূর্তি ভাল করতে চায় নিজের। আর সেটা করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের লড়াইয়ের ধর্মটাকেই বিসর্জন দিতে চাইছে। এত বড় কথা বলল যে, লাইনের ও পারে কেউ গেলে নিজেরাই শাস্তি দেবে!”
টিভিতে সিরিজের যারা খেলা দেখাবে সেই টিভি চ্যানেল নাম দিয়েছে ‘অগ্নিপথ’। ক্লার্ক তাতে এমন জল ঢেলে দেওয়ার পর মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এলেন। তাঁর গলাতেও শান্তির সুর। পুরো বড় বালতি না হলেও এক মগ জল। “সেই সময় কিছু ব্যক্তি ভুল করায় বিতর্কটা এত বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। আমরা চাই এ বার সিরিজ জমাটি হোক কিন্তু বিতর্কের জন্ম না দিয়ে। স্পোর্টসম্যান হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। লোকে রোল মডেল হিসেবে আমাদের অন্য চোখে দেখে।”
শনিবার মেলবোর্নে ব্যাগি গ্রিন অধিনায়ক ক্লার্ক। ছবি: এএফপি
এমনিতে শান্তির ঐরাবত হিসেবে অধিনায়কদ্বয়ের যুগ্ম আবেদন শহর মেলবোর্নের মেজাজের সঙ্গে সুপার ফিট! এ বারের বড়দিনে শহরের স্লোগান হল, অতীতে এ জিনিস আর কখনও দেখেননি। নতুন কী কী, না মেলবোর্নের প্রাণকেন্দ্র ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট স্টেশন থেকে শুরু করে যত তাৎপর্যপূর্ণ সব বাড়ি আছে সব ক’টাকে ‘গিফ্ট র্যাপ’ দিয়ে সাজানো হয়েছে। দেখলে মনে হবে হ্যারি পটারের সেট। এমসিজি থেকে ট্যাক্সিতে সাড়ে তিন মিনিট দূরত্বের ফেডারেশন স্কোয়ারের ক’দিনের জন্য নামকরণ হয়েছে ক্রিসমাস স্কোয়ার। ট্রামগুলো সুসজ্জিত হয়ে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে যেমন ভিক্টোরিয়ার সামনে চলে, তেমনই ফিটনে চেপে যাচ্ছে সুসজ্জিত নারী-পুরুষ। সামনের দোকানপাটে উত্তুঙ্গ ‘সেল’। প্লেয়ারদের হোটেল থেকেই কিছু দূরে চ্যাপেল স্ট্রিট। অস্ট্রেলিয়ার ফ্যাশন ও স্টাইলের বিখ্যাত রাজধানী। সারা পৃথিবীর ডিজাইনার ব্র্যান্ড সব এখানে। শ্যানেল থেকে ভার্সাচি। লিজ হার্লি থেকে অস্ট্রেলিয়ার নামী অভিনেত্রী-মডেলরা ঘুরে ঘুরে ছুটির দিনে শপিং করছেন। ভুরিভোজের সেরা আকর্ষণ সামনের চায়না টাউনে শুধু চাইনিজই নেই। জাপানি, তাই, কোরীয় সব রকম খাবার। সেখান থেকে বার হয়ে কলিন্স স্ট্রিটের ওপর একটা কৃত্রিম ঝরনা। ‘সেলাম নমস্তে’ ছবিটায় বারবার স্পটটা দেখিয়েছিল। সেই ঝরনার সামনে পর্যটকেরা ছবি তুলছে। নারী-পুরুষ গাইছে। সামনের দোকান থেকে ভেসে আসছে ক্রিসমাস ক্যারল। বিনা লাইটিংয়েও স্বর্গীয় আলোকসজ্জা। দেখলে মনে হবে পৃথিবীতে দুঃখ নেই। দারিদ্র নেই। মৃত্যু নেই। উগ্রপন্থা নেই। পৃথিবী কেবল বিনোদন, শান্তি আর উৎসবের। আর এমসিজি-র ক্রিকেট সেই থিম পুজোরই একটা অংশ। কাজেই ‘স্লেজিং’ শব্দটা তো সেখানে না থাকারই কথা!
আর এখানেই প্রশ্ন। মেলবোর্ন নাহয় এ বারের বড়দিনে একটু বেশি জাঁকজমকপূর্ণ। কিন্তু শান্তি আর উৎসবের ঢালাও আয়োজন তো প্রতি বড়দিনেই এখানে নৈমিত্তিক। চিরকাল শহরের সেই ‘থিম’কে অগ্রাহ্য করেই অস্ট্রেলীয় অধিনায়কেরা বক্সিং ডে টেস্ট শুরুর আগে রণহুঙ্কার দিয়েছেন। এ বার এমন ল্যাতপেতে, আগেই ক্ষমাপ্রার্থী এ রকম কেন?
নানান ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে। আগের সেই টিম নেই আর অস্ট্রেলিয়ার। সেই রাম নেই। অযোধ্যাও না। মাসখানেক আগে ৪৭ অল আউট অবধি হয়েছে। ম্যাকগ্রা বা ওয়ার্ন রণহুঙ্কার দিয়ে সেটার চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ধরতেন। নতুন অনভিজ্ঞ বোলিং লাইন আপের পক্ষে সম্ভব নয়। দুই, পন্টিং অধিনায়ক হিসেবে যে উচ্চতায় ছিলেন, ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে যত দৃঢ় ছিলেন, ক্লার্ক তা নন। তিনি ভাবমূর্তি রক্ষায় অনেক সচেতন। তিন এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ তিন, আইপিএল দেখিয়েছে দেশজ রেষারেষি করে কোনও ফায়দা নেই। বরঞ্চ ক্লাবের হয়ে একসঙ্গে শান্তিতে খেললে অনেক অর্থ উপার্জন সম্ভব। ভারতীয় প্লেয়ারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে ফ্র্যাঞ্চাইজিরা না-ও নিতে পারে। চার, ভারতীয় বোর্ডকে না চটাতে চাওয়া। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া জানে ভারতীয় বোর্ড হল বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। অনেকের মতে ওয়াল স্ট্রিট। ওয়াল স্ট্রিটকে চটিয়ে বাণিজ্য করা সম্ভব নয় এই উপলব্ধি সদস্য দেশগুলোর এমন হয়ে গিয়েছে যে, তারা আইসিসি-কে পাত্তা না দিতে পারে। ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস নেই।
বডিলাইন
ডন ব্র্যাডম্যানকে আটকাতে ইংল্যান্ড অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘ফাস্ট লেগ থিওরি’। ১৯৩২-৩৩ অ্যাসেজ সফরে তিনি ফাস্ট বোলার হ্যারল্ড লারউডকে দিয়ে ব্র্যাডম্যানদের শরীর লক্ষ্য করে বল করিয়েছিলেন। যা দেখে এক সাংবাদিক ‘বডিলাইন’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।

বলিলাইন
ভারতের ২০০৭-০৮ অস্ট্রেলিয়া সফরের আগুনে মেজাজকে প্রচারমাধ্যম ‘বলিলাইন’ অ্যাখ্যা দেয়। সিডনি টেস্টে আম্পায়ারদের ভুল সিদ্ধান্তে দু’দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। আগুনে ঘি পড়ে হরভজন-সাইমন্ডস ঝামেলায়। ‘বডিলাইন’ বিতর্ক এবং বলিউডের চিত্রনাট্য, দু’য়ে মিলে ‘বলিলাইন’-এর জন্ম।
বডিলাইনের নিষ্পত্তি হয়েছিল সেই তিরিশের দশকে অস্ট্রেলিয়া ইংরেজ গভর্নর জেনারেল নিতে অস্বীকার করায়। বলিলাইনের কালো ছায়া যাতে চলতি সিরিজে না পড়ে তার জন্য বিসিসিআই নাকি আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে। আর তারই নাকি প্রতিচ্ছবি ক্লার্কের মন্তব্য, “কেউ লাইনের ও পারে গেলে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া নিজে থেকে ব্যবস্থা নেবে। আইসিসি নিক বা না নিক।” বিসিসিআই এখন এমন জুজু যে, গ্রেগ চ্যাপেলের বই পর্যন্ত ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া সেন্সরশিপ করতে বাধ্য হয়। পাছে ভারত রেগে যায়!
এই চিন্তাধারা অনুযায়ী মাইকেল ক্লার্কের বক্তব্য চাঞ্চল্যকর নয়। এটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মারদাঙ্গা-লড়াই ছাড়া ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ কেমন আলুনি হয়ে যাবে না? ব্যাগি গ্রিন বনাম তেরঙ্গা ম্যাচে কে আর মেলবোর্নের ক্রিসমাস দেখতে চায়? কেউ কেউ মনে করছেন একবার খেলা শুরু হয়ে গেলে আর রেষারেষি বাঁধতে কতক্ষণ। বিশেষ করে ডিআরএস এবং হটস্পট মেনে নিতে ভারতের অস্বীকৃত হওয়া তো একটা স্পর্শকাতর জায়গা খুলেই রেখেছে। প্লেয়াররা জঙ্গি না হোক, অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার ফোঁস করতে কতক্ষণ?
এক ক্রিকেটার বলছিলেন, “বিতর্ক লোপ পাক। কিন্তু চিরাচরিত তীব্রতা আর চড়চড়ে মেজাজটা যেন থাকে। নইলে ব্যাপারটা জমে না। ইন্টারেস্টিং হয় না ভারত-অস্ট্রেলিয়া।”
ক্রিকেটারের নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। বড়দিনের শান্তিকামী বাতাবরণে তাঁর কথাটা? না কি ক্লার্কের অস্ট্রেলীয় চরিত্রবিরোধী মিনমিনে হয়ে পড়া? কোনটা বেশি বিস্ময়কর কে জানে!

৪-০ জিতলেও ধোনিরা শীর্ষে নয়
মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়াকে চার টেস্টের সিরিজে ভারত ৪-০ হারালেও আইসিসি টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে ধোনির টিম এক নম্বরে আসবে না। তবে সেক্ষেত্রে এক নম্বর ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের পয়েন্টের ফারাক কমে দাঁড়াবে মাত্র ৩। ধোনিরা সিরিজ ৩-১ জিতলে ভারতের মোট পয়েন্ট দাঁড়াবে ১২০। সিরিজ ২-২ হলে ভারত, অস্ট্রেলিয়া দু’দলেরই ২ পয়েন্ট করে কমবে। অস্ট্রেলিয়া ৪-০ জিতলে ভারতের পয়েন্ট কমে হবে ১১১। অস্ট্রেলিয়া ৩-১ জিতলে ধোনির দলের পয়েন্ট দাঁড়াবে ১১৩। টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে এই মুহূর্তে প্রথম চার যথাক্রমে ইংল্যান্ড (১২৫), ভারত (১১৮), দক্ষিণ আফ্রিকা (১১৬) ও অস্ট্রেলিয়া (১০৩)।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.