ছোটখাটো গাড়ি দুর্ঘটনা নয়। চাকরি হারানোর ভয় নয়। এমনকী বিবাহ বিচ্ছেদের আশঙ্কাও নয়। দুনিয়া জুড়ে তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার (আইটি ম্যানেজার)-দের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে সংস্থার ভাঁড়ার থেকে গোপন তথ্য চুরি যাওয়ার আতঙ্ক।
ইন্টারনেট সর্বস্ব ফেসবুক-টুইটার-স্মার্ট ফোনের জমানায় তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে গিয়ে হিমসিম খাওয়ার এই বৃত্তান্ত উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায়। আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় দু’হাজার কর্মীকে নিয়ে সমীক্ষাটি করেছে মার্কিন শেয়ার বাজার ন্যাসডাকে নথিভুক্ত ওয়েবসেন্স। তথ্য চুরি রোখার ক্ষেত্রে পরামর্শ দান এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরবরাহে তারা বিশ্বে অন্যতম অগ্রণী সংস্থা বলে দাবি ওয়েবসেন্সের।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া দু’হাজার জনের মধ্যে এক হাজার ম্যানেজার স্তরের তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার। বাকি অর্ধেক অন্যান্য শাখার কর্মী। আর, এই সমীক্ষা থেকেই উঠে এসেছে চমকে দেওয়ার মতো কিছু তথ্য। যেমন, ‘বৌ খোয়ানো’র থেকেও তথ্য হারানোর সম্ভাবনাকে বেশি ভয় পেয়েছেন ৭২ শতাংশ কর্মী!
ঘাড়ের উপর চেপে থাকা দেনার দায় নিয়ে নাছোড় দুশ্চিন্তা। ছোটখাটো পথ দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার দুর্ভাবনা। কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের মতো তুমুল মানসিক টানাপোড়েনের সিদ্ধান্ত এই সমস্ত কিছুর তুলনায় নিজের জিম্মায় থাকা কোনও তথ্য চুরি যাওয়ার চাপ অনেক বেশি বলে মনে করছেন ওই ৭২ শতাংশ কর্মী। শুধু তাই নয়। কোনও কারণে সংস্থার তথ্য এক বার ফাঁস হয়ে গেলে, তার পরও সেখানে কাজ করা চাকরি হারানোর থেকেও বেশি মানহানিকর বলে ১৪ শতাংশ আইটি ম্যানেজারের অভিমত।
আজকের কর্পোরেট দুনিয়ায় তথ্যের নিরাপত্তা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, তা বিঘ্নিত হলে চাকরি যেতে পারে বলে সমীক্ষায় জানিয়েছেন ৮৬ শতাংশ কর্মী। এর মধ্যে রয়েছে, সিইও-সহ সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের জিম্মায় থাকা তথ্যের গোপনীয়তা ভঙ্গ হওয়ার ভয়, কোনও ভাবে টুইটার-অর্কুট-ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটে সংস্থার গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার আতঙ্ক ইত্যাদি।
এই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, সমীক্ষায় উঠে আসা পরিসংখ্যানে তা-ও স্পষ্ট। যেমন, সিইও-সহ শীর্ষ কর্তাদের দফতর থেকে সত্যিই তথ্য চুরি যাওয়ার কথা জানিয়েছেন ২৪ শতাংশ কর্মী। ৩৪ শতাংশ বলেছেন সোশ্যাল নেটওয়াকির্ং ওয়েবসাইটে তথ্য ফাঁসের ঘটনা। আর ৩৭ শতাংশ আইটি ম্যানেজার জানিয়েছেন, সংস্থার জরুরি তথ্য কী ভাবে স্রেফ হারিয়ে ফেলেছেন সেখানকারই কোনও কর্মী। আজকের ইন্টারনেট-নির্ভর দুনিয়ায় কোনও কারণে সংস্থার গোপন তথ্য এক বার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের পর্দায় পৌঁছে গেলে, মুহূর্তের মধ্যে তা পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে। প্রতিটি মানুষের নাগালে। তাই গোড়াতেই এই সম্ভাবনা রোখা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ম্যানেজারদের সামনে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই সব ওয়েবসাইটে তথ্য যাওয়া আটকাতে বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করেন মাত্র ৪৮ শতাংশ আইটি ম্যানেজার। প্রথাগত ‘অ্যান্টি ভাইরাস’ বা ‘ফায়ার ওয়াল’ ব্যবহার করলেও, বিদ্যুৎ গতিতে বদলাতে থাকা প্রযুক্তির যুগে তা তথ্য সুরক্ষিত রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয় বলে মেনে নিচ্ছেন অন্তত ৬০ শতাংশ কর্মী। যে কারণে সব সময়ে তথ্য চুরি যাওয়ার আতঙ্কে ভুগছেন তাঁরা।
অবশ্য এ বিষয়ে আশার আলোও দেখা গিয়েছে এই সমীক্ষায়। কারণ সেখানে স্পষ্ট যে, বিশ্ব জুড়ে সংবাদপত্র, টিভি-সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি তথ্য চুরি বা ফাঁসের ঘটনা খবরের শিরোনামে উঠে আসায় এ নিয়ে নির্দিষ্ট নীতি তৈরিতে মন দিচ্ছে বহু সংস্থা। যেমন, এ ধরনের ঘটনা রুখতে এই খাতে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ৪০ শতাংশেরও বেশি আইটি ম্যানেজার। সংস্থার ভাঁড়ারে থাকা তথ্যকে আরও সুরক্ষিত রাখতে আইটি হেড (তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের শীর্ষ কর্তা)-এর পাশাপাশি এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন সিইও, ম্যানেজিং ডিরেক্টর-সহ শীর্ষ কর্তারাও।
ওয়েবসেন্সের সিনিয়র ডিরেক্টর (বিপণন) টম ক্লেয়ারের দাবি, “এই সমীক্ষার পর তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবে অধিকাংশ সংস্থা। নতুন করে এ ধরনের ঘটনার জেরে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান নেবে।” তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়া যে গতিতে বদলাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্যের সুরক্ষার জন্য সংস্থাগুলিও উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহারের পথে হাঁটবে বলে মনে করেন তিনি। |