|
|
|
|
কড়া সমালোচনা সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে |
ফের বড় শরিককে বিঁধল সিপিআই |
বরুণ দে • মেদিনীপুর |
জানুয়ারির শেষে নির্ধারিত রয়েছে সিপিএমের জেলা সম্মেলন। রাজ্যে পালাবদলের পরে একদা ‘লালদুর্গ’ পশ্চিম মেদিনীপুরে সিপিএমের সম্মেলন ঘিরে আগ্রহ নানা কারণেই। দুর্গের পতনে নেতৃত্বের দায় কতখানিসে নিয়ে সিপিএমের লোকাল, জোনাল সম্মেলনে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠছে। সিপিএম নেতৃত্বের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিল শরিক সিপিআইয়ের মূল্যায়ন।
সোমবারই শেষ হয়েছে সিপিআইয়ের ২২ তম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্মেলন। বড় শরিক সিপিএমের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করা হয়েছে সম্মেলনের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে। গত পঞ্চায়েত, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য সরাসরি সিপিএমকেই কাঠগড়ায় তুলেছে সিপিআই। ‘সিপিআই নির্বাচন-সর্বস্ব পার্টি নয়’ দাবি করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, বামফ্রন্ট আর বৃহৎ-শরিক সিপিএম সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। বামফ্রন্ট বহু সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা। বহু পরীক্ষায় উত্তীণর্র্ সেই সম্মিলিত শক্তিকে এক দলের হুকুমদারি-জোটে পরিণত করার চেষ্টা মানুষ পছন্দ করেনি। আমাদের পার্টি প্রতিটি প্রধান প্রধান প্রশ্নে বামফ্রন্টের অভ্যন্তরে বহু ক্ষেত্রে লিখিত বক্তব্য হাজির করলেও তা থেকে গিয়েছে চার দেওয়ালের মধ্যেই’। বলা হয়েছে, ‘বামফ্রন্টকে ফ্রন্ট হিসেবে পরিচালনা না-করা, নানা প্রশ্নে সিপিএমের মতকে বামফ্রন্টের মত বলে চালানো, ফলে ফ্রন্টের মধ্যে ব্যাপক অনৈক্য, শিল্পায়নের প্রশ্নে পঞ্চায়েত জনপ্রতিনিধি এমনকী মানুষকে উপেক্ষা করে পুলিশ-প্রশাসন, আমলা নির্ভরতা, পঞ্চায়েত-গ্রাম সংসদ-গ্রাম উন্নয়ন সমিতি প্রভৃতি গণতান্ত্রিক সংস্থাকে গণতান্ত্রিক ভাবে পরিচালনা করতে না-পারা, দলীয় সংকীর্ণতা-অস্বচ্ছতা-দাম্ভিকতায় মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলনই এই নির্বাচনী ফল’।
একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে চাওয়া-পাওয়াই সর্বস্ব হয়ে উঠেছিল বলে কটাক্ষ করে সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মূল কথা যেহেতু ক্ষমতা দখল তাই যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখলের জন্য নীতি-নৈতিকতা বিসর্জনের ঘটনা বাড়তে বাড়তে এই অবস্থায় পৌঁছেছিল। গায়ের জোরে ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া, যাদের হাতে বেশি ভোট---পার্টিতে তাদের মর্যাদা বেশি, গ্রামীণ জীবনে উঠতি ধনীরা বেশি মর্যাদা পেল। এই আদর্শহীনতা, দুর্নীতি, আত্মদম্ভ জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। এমনকী বহু নেতার বিস্ময়কর বাড়বাড়ন্ত বহু ক্ষেত্রে শীর্ষ নেতাদের কটাক্ষ-বেসামাল-অসংযত মন্তব্য বহু বামপন্থী অনুগামীকে বিরক্ত করেছে’। এখানেও পরোক্ষে সমালোচনা সেই সিপিএম নেতাদেরই। এরই সঙ্গে যোগ করা হয়েছে, ‘চাওয়া- পাওয়ার পরিমণ্ডলে কমিউনিস্টদের মূল কাজ ছিল, সামাজিক চেতনাকে সমাজতন্ত্রমুখী করে তোলা। কিন্তু, চেতনা থেকে গেল গোলকধাঁধায় আবদ্ধ। যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বামফ্রন্টের গর্ব, তার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়াল পার্টি। জনগণের প্রতিষ্ঠান বদলে হল পার্টি-নিয়ন্ত্রিত সংস্থা। পঞ্চায়েত-গ্রাম উন্নয়ন সমিতি-গ্রাম সংসদ তার আকর্ষণ হারাল। জনগণের কণ্ঠস্বরের বদলে স্থান নিল পার্টির কণ্ঠস্বর। চাওয়া-পাওয়ার পরিমণ্ডল প্রসারিত হতে হতে সচেতন সংগ্রামী মানসিকতা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে’।
জেলা বামফ্রন্ট খাতায়-কলমেই রয়েছে, তার কার্যকরী ভূমিকা নেই-এমন মন্তব্যও করা হয়েছে প্রতিবেদনে। শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘বিগত দিনগুলিতে জেলা বামফ্রন্ট একটা নিয়মরক্ষার কমিটি হিসেবে কাজ করেছে। প্রধানত, রাজ্য বামফ্রন্টের সার্কুলার বাস্তবায়িত করার সংস্থা হিসেবে কাজ করেছে। জেলায় বামফ্রন্ট কী ভাবে চলবে, বিভিন্ন ইস্যুতে বাম-বিরোধীদের আক্রমণের মোকাবিলা কী ভাবে হবে, বাম-ঐক্যকে কী ভাবে তলা পর্যন্ত প্রসারিত করা যায়---ইত্যাদি কোনওটাই বামফ্রন্টের সভায় আলোচ্য হয়নি। ফলে, আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যেই সভার কাজ শেষ হয়েছে’। জেলা বামফ্রন্টের ভূমিকার (আসলে জেলা সিপিএম নেতৃত্বের ভূমিকা) সঙ্গে ‘সংস্থা’র তুলনা টানায় শোরগোল পড়েছে সিপিএমের অন্দরেও। ছোট শরিকের এ হেন মূল্যায়ন নিয়ে অবশ্য সিপিএমের একাংশও একমত। দলের জেলা কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, “এতে কারও কারও হয়তো বিড়ম্বনা বাড়বে। কিন্তু, বাস্তব পরিস্থিতির কথাই তুলে ধরা হয়েছে।” ওই সিপিএম সদস্যের কটাক্ষও বস্তুত দলের জেলা নেতৃত্বের প্রতিই। যা সিপিএমের জেলা সম্মেলনে সম্ভাব্য ঝড়েরই পূর্বাভাস।
ইদানীং সিপিএমের তরফে প্রচার করা হচ্ছে, রাজ্য সরকার দ্রুত সমর্থন হারাবে এবং বামফ্রন্টই পুনরায় ক্ষমতায় আসবে। এই ধারণাও ভ্রান্ত বলে মনে করছে সিপিআই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মা- মাটি-মানুষের সরকার জনসমর্থন দ্রুত হারাবে, তখন মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পারবে এবং পুনরায় বামফ্রন্টকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হবে--এমন ভ্রান্ত অকমিউনিস্ট চিন্তা সিপিআই করে না। মানুষ তার অভিজ্ঞতায় যেমন এই সরকারের চরিত্র বুঝবেন, বামপন্থীদের গণ-আন্দোলন যেমন তাদের বুঝতে সাহায্য করবে, তেমন একই বামফ্রন্ট ফিরে আসতে পারে না। ত্রুটি-বিচ্যুতিমুক্ত আত্মশুদ্ধ সংশোধিত উন্নততর পরিবর্তিত বামফ্রন্টই ফিরে আসবে’। আত্মসমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এ কথা অনস্বীকার্য যে পার্টির বহু সংখ্যক সদস্য নিষ্ক্রিয়। নিষ্ক্রিয়দের তাড়ানোটাই এর প্রতিকার নয়। বরং, তাদের সক্রিয় করাটাই পার্টির কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ’।
|
|
|
|
|
|