‘কোনও রকম দুর্ঘটনা বা মৃত্যু হলে কেউ দায়ী থাকবে না’ লেখা ফর্মে সই করিয়ে যখন হাতে ইয়াস মারিনা সার্কিটের একটা সবুজ ব্যান্ড পরিয়ে দেওয়া হল, তখনও কিছুই আঁচ করিনি। মনে মনে ভেবেছি, টেস্ট ড্রাইভ তো!
চশমা আর বেল্ট খুলে যখন মুখে মোজার মতো মুখোশ আর হেলমেট পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখনও জানতাম না পরের পাঁচ মিনিটে জীবন তার যাবতীয় রোমহর্ষক সম্ভাবনা, বিপদ আর উত্তেজনা নিয়ে হাজির হবে। ট্র্যাকে পৌঁছনোর আগে ম্যাকডার স্পোর্টসের কর্মী নলিনীর রসিকতা, “মরলে তো এক বারই মরবেন। উঠে পড়ুন!”
ট্র্যাকে গিয়ে ঝাঁ চকচকে র্যাডিক্যাল এসআরথ্রি-র ড্রাইভারের দিকে তাকাতে গিয়েই চমক। ড্রাইভার্স সিটে ফর্মুলা ওয়ানের ফেরারির জাঁ কার্লো ফিসিকেলা! ফিসিকেলার পাশের সিটে বসে ফর্মুলা ওয়ানের ট্র্যাকে মানে সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে বাইশ গজে! প্রাক্তন ফোর্স ইন্ডিয়া ড্রাইভার আমার দিকে গ্লাভস পরা বুড়ো আঙুল তুলে বললেন, “আর ইউ এনজয়িং?” |
‘এনজয়’ বলে ‘এনজয়’! মাথা নেড়েছি কি নাড়িনি, ফিসিকেলা বললেন, “কুল, রিল্যাক্স!” রিল্যাক্স যে কী হতে পারে, বুঝলাম পরের তিন সেকেন্ডে। যখন তিন সেকেন্ডের মধ্যে ০ থেকে স্পিডোমিটারের কাঁটা ছুঁল ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। এক একটা হেয়ারপিন বেন্ড আসছে আর প্রবল ঝাঁকুনি লাগছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি সামনে লেখা বোর্ডে ধাক্কা মারল গাড়ি। কিন্তু ধাক্কা নয়, গাড়ি শেষ মুহূর্তে চমৎকার ভাবে কেটে ট্র্যাকে থাকছে, ঠিক যেন মেসির ড্রিবল। পাঁচ মিনিট, ইয়াস মারিনা ফর্মুলা ওয়ান সার্কিটে দুটো পাক আর তার পরই পিটে ঢুকে পড়ে বুড়ো আঙুল তুলে ফিসিকেলা বললেন, “ইউ আর ফাইন মেট!’
আর গাড়ি থেকে নামার সময় প্রশ্ন, “তুমি ভারতীয় বুঝলাম। কোথাকার?” কলকাতা শুনে হাসলেন, “সিটি অব জয়? ফাইন। আমি কলকাতার হয়ে গাড়ি চালাতেই পারি!”
ফেরারির ড্রাইভার কি না সুপারকার সিরিজে কলকাতার টিমের হয়ে গাড়ি চালাতে চান। যে টিমটা এখনও অবিক্রীত! পরে শহরের ছেলে এবং এই সুপার সিরিজে নামার অন্যতম প্রার্থী অমিত্রজিৎ ঘোষ বলছিলেন, “তা হলে তো দুর্দান্ত ব্যাপার হবে। আমাদের টিমটাই ট্রফি নিয়ে যাবে!” আসলে টেস্ট ড্রাইভের পরে মিডিয়ার লোকজনকে ট্র্যাকে ঘোরানোর ভাবনাটা অভিনব। ম্যাকডার স্পোর্টসের সিইও দর্শন বলছিলেন, “ফর্মুলা ওয়ানে যা কখনও সম্ভব নয়, এখানে সেটা সম্ভব। কারণ গাড়িগুলো টু-সিটার। সে জন্যই আপনাদের ঘোরানো। আর সুপার সিরিজের স্বার্থে ড্রাইভাররাও রাজি ছিল।”
চন্দক, নিল জার্নি, লুইজি, ফিসিকেলার মতো নামীদের সঙ্গে ট্র্যাকে দু’পাক ঘোরার অভিজ্ঞতা যদি অনন্য হয়, সুসংবাদ বলতে ফিসিকেলা বললেন, “এফ ওয়ানের সঙ্গে তুলনা করবেন না। এটা একেবারে অন্য রকম ভাবনা। তবে গাড়ি আরও উন্নত করা যায়। আশা করি, সংগঠকরা সেটা ভাববেন।” উচ্ছ্বসিত করুণ চন্দকও। “সবাই আমাকে প্রশ্ন করছে, সুপার সিরিজে কোন টিমের হয়ে নামব। অবশ্যই প্রথম পছন্দ হবে চেন্নাই। কিন্তু চেন্নাই না হলেও ক্ষতি নেই। আসল কথা হল মোটরস্পোর্ট। আমার তো ধারণা, এই লিগ জমে যাবে,” টেস্ট ড্রাইভ শেষে বক্তব্য তাঁর।
দেশের বিভিন্ন শহরে ন’টা টিম, থাকছে মোট ২৭ জন ড্রাইভারের পুল, যাঁর মধ্যে রয়েছেন দু’জন মেয়ে। সুইজারল্যান্ডের মেয়ে সিন্ডি আলেমান যেমন। নিয়মিত ছেলেদের সঙ্গে লড়ে আন্তর্জাতিক সার্কিটে ক্লকে পাওয়া সিন্ডি বলছেন, “সবাই ধরে নেয়, মোটরস্পোর্ট ছেলেদের খেলা। আমি প্রমাণ করতে চাই, একেবারেই তা নয়।”
সব মিলিয়ে প্রথম দর্শনেই আই ওয়ান সুপারকার সিরিজ সুপারহিট। আন্তর্জাতিক মানের এফওয়ান ট্র্যাক, নামী ড্রাইভার, এফওয়ানসুলভ পরিকাঠামো, সবই আছে। শুধু শহরে-শহরে রেষারেষিটা দরকার। টিভিতে সরাসরি দেখাবে বলে সেটাও হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
|
এক নজরে সুপার কার সিরিজ
|
কারা অংশ নেবে: দেশের বিভিন্ন শহরের ন’টা দল। দুটো গাড়ি, প্রতি টিমে দু’জন ড্রাইভার। এক জন আন্তর্জাতিক, এক জন ভারতীয়।
লিগ কী ভাবে: মোট দশটা রেস হবে। প্রতি রেস ৩৫ মিনিটের। হবে শনি ও রবিবার। প্রথম হলে সেই টিম পাবে ১৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় হলে ১২, তৃতীয় হলে দশ। এ ছাড়াও এফ ওয়ানের মতো ড্রাইভারদের ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশিপ থাকবে। থাকবে দ্রুততম ল্যাপের জন্য পয়েন্ট।
কোথায় হবে: সেপাং, মালয়েশিয়া (২১-২২ জানুয়ারি), সাখির, বাহরিন (৩-৪ ফেব্রুয়ারি), লোসাইল, কাতার (১০-১১ ফেব্রুয়ারি), গ্রেটার নয়ডা, (২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি) এবং ইয়াস মারিনা, আবু ধাবি (৯-১০ মার্চ)।
পুরস্কার মূল্য: ২০ লক্ষ মার্কিন ডলার। |
|