প্রবন্ধ ২...
কার্যসিদ্ধির সোজা পথ ‘লবি’ করার অধিকার
ক্ষ্মী মিত্তল আরসেলর কিনবেন। বাজার থেকে শেয়ার তুলতে শুরুও করে দিয়েছেন। কিন্তু লুক্সেমবুর্গ সরকার মানতে পারছে না, তাদের দেশের সংস্থা কিনা নিয়ে নেবেন এক জন ভারতীয়? শুরু হল যুদ্ধ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে জীবনের সব মঞ্চে লড়াই। যার অন্যতম লক্ষ্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বোঝানো যে মিত্তল এই সংস্থা কিনে নিলে আসল ক্ষতি হবে আরসেলর এবং তার সঙ্গে যুক্ত সবারই। অর্থাৎ লবি করতে হবে এমন ভাবে যাতে বিরোধিতার তীব্রতায় মিত্তল লুকোনোর জায়গাও না পান। কিন্তু এ কাজের জন্য প্রয়োজন পেশাদার। লুক্সেমবুর্গ সরকার নিয়োগ করল গাভিন অ্যান্ডারসনকে। গাভিন-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর বাইরন আওসি নিজেই মাঠে নামলেন লুক্সেমবুর্গ সরকারের হয়ে।
মিত্তল তো এই লড়াইয়ে প্রথম বোড়ে এগিয়েছেন। তাঁর দায় আরও বেশি। তাঁকে জিততেই হবে। আজ সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে ভারতীয়দের জেতার খিদে একটু বেশিই। অন্যরা যেখানে দাঁড়িয়ে লড়াই ফেলে পালাবে, সেই বিন্দু থেকেই নতুন করে লড়াইয়ের কথা ভাবতে শুরু করতে পারে ভারতীয়রাই। মিত্তলও সেই একই ছাঁচে তৈরি। গড়পড়তা ভারতীয়দের যা জেতার খিদে তার থেকে হয়তো একটু বেশিই আছে তাঁর। তিনি যুদ্ধে নিজের বল কতটা থাকা উচিত তার অঙ্ক আগেই কষে রেখেছেন। এই যুদ্ধে তাঁর লবির ঘোড়া তাই আঙ্গাস মেটল্যান্ড। মেটল্যান্ড নামের এক জনসংযোগ সংস্থার মালিক। বয়সের কারণে ব্যবসার একটা বড় অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন অন্য আর একটি সংস্থাকে। কিন্তু মিত্তলের কাছে তিনিই যোগ্যতম। এই ধরনের যুদ্ধে তাঁর গভীর অভিজ্ঞতার কারণেই। তাই লুক্সেমবুর্গ বোড়ে সাজানোর আগেই তাঁর ঝুলিতে মেটল্যান্ড।
তার পরে কী হল আমরা সবাই জানি। আরসেলরের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে মিত্তলের নাম। মাঝখানের গল্প অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু যাঁরা সিদ্ধান্ত নেন তাঁদের কাছে নিজের যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা যে ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে তার কোনও ঠিক দিশা পাওয়া যায় না। তবে আজ যাকে আমরা ‘লবি’ করা বলি, আইন মোতাবেক তার শুরু গ্রেট ব্রিটেন অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং প্রায় কাছাকাছি সময়ে। কেউ কেউ বলেন ওয়াশিংটনের উইলার্ড হোটেলের লবিতে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থ মেটাতে সাংসদদের সঙ্গে বসতেন আর সেই থেকেই ‘লবি’ শব্দের ব্যবহার শুরু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তো ‘লবি’ করা আইনে স্বীকৃত অধিকার। তার ফল আমরা জানি সেই বিখ্যাত (প্রকাশ কারাট বলবেন ‘কুখ্যাত’) ভারত-মার্কিন নিউক্লিয়ার ডিল থেকেই। বুশ ভারত ভ্রমণে এসে ঘোষণা করে গেলেন। অথচ মার্কিন সেনেট এবং হাউস অব রিপ্রেসেনটেটিভের সদস্যরা অন্ধকারে। সাংসদদের স্বাভাবিক কারণেই খুব রাগ। স্বদেশরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় মার্কিন নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। গ্যারি একারম্যান তখন এক গুরুত্বর্পূণ সাংসদ এবং মার্কিন কংগ্রেসের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির প্রধান এবং স্বদেশবাবুর বন্ধু। স্বদেশবাবুর উৎসাহেই তিনি কলকাতাও ঘুরে গিয়েছেন। তাঁর ক্যাম্পেনের জন্য মোটা অঙ্কের ডলার নিজের পকেট থেকে দিয়েই থামেননি, বাকি খরচের টাকা জোগাড়েরও উদ্যোগ নিতেন স্বদেশবাবু। ফলে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। একারম্যান স্বদেশবাবুকে বলেন বুশের এই প্রতিশ্রুতি আইনে পরিণত করতে হবে। কিন্তু ওই বিল নাকি ‘ডি ও এ’ (ডেড অন অ্যারাইভাল)। এর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সব চেষ্টা বৃথা। সাংসদরা নাকি এতটাই রেগে রয়েছেন গোটা বিষয়টা নিয়ে।
স্বদেশবাবু এর পরে শুরু করেন সেই সব ভারতীয়, যাঁরা সাংসদদের নির্বাচনের খরচ মেটাতে মোটা টাকা দান করেন তাঁদের একজোট করতে। শুরু হল ওয়াশিংটন অভিযান। মার্কিন সমাজে তাবড় প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় ওয়াশিংটনে একযোগে লবি শুরু করলেন। সাংসদদের দরজায় কড়া নেড়ে বোঝাতে শুরু করেন এই চুক্তি মার্কিনদের স্বার্থে কতটা জরুরি। শুরু হয় আর এক খেলা। কলকাতার এক সংস্থাকে বরাত দেওয়া এমন একটা সফটওয়ার তৈরি করার যাতে নাম আর জিপ কোড (আমাদের পিন কোড) দিলেই সেই ব্যক্তির নামে তাঁদের সেনেটর এবং হাউস অব রিপ্রেসেনটেটিভস-এর সাংসদের নামে চিঠি বানিয়ে পাঠিয়ে দেবে। এর ফল? সাংসদদের ইনবক্স ভর্তি হয়ে গেল ভারতের সঙ্গে নিউক্লিয়ার চুক্তির সমর্থনে লেখা চিঠিতে। একেবারেই ‘না’ থেকে চাকা ঘুরতে শুরু করল ‘হাঁ’-র দিকে। আর যা হয়। রাজনীতিতে স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটার লোক তো কমই। এর ফলে পাশ হয়ে গেল বিল। স্বদেশবাবু নিজের পকেট থেকে এই বাবদ খরচ করেছিলেন লক্ষাধিক ডলার। আর নিজের ব্যবসা ছেড়ে ওয়াশিংটন দৌড়ের যে ক্ষতি, তার অঙ্ক তিনি করেননি।
উনি যেটা করেছিলেন সেটা ভাল না মন্দ? সরকার সহ একটা গোটা দেশের জনমতকে নিজের দিক ঘুরিয়ে আরসেলর কেনার যে কৌশল মিত্তল নিয়েছিলেন তা ভাল না মন্দ? এ ব্যাপারে সঠিক কোনও মতে পৌঁছনো খুবই কঠিন। কিন্তু ভারতের জনমত এই ধরনের ‘লবি’ নিয়ে যে খুব একটা স্থির জায়গায় পৌঁছিয়েছে তা বলা যায় না। টু জি কেলেঙ্কারির ইতিহাস প্রাসঙ্গিক। লবি নিয়ে লিখতে গিয়ে সুগত হাজরা নিরা রাডিয়া প্রসঙ্গে খুব বড় করে ঢুকতে পারেননি। কারণ বইটি লেখা যখন প্রায় শেষ, তখন এই কেলেঙ্কারির শুরু। স্বদেশবাবু বা আরসেলর প্রসঙ্গও তাঁর লেখায় নেই। কিন্তু তাঁর বইতে তিনি চেষ্টা করেছেন বিশ্ব মঞ্চের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের লবির ইতিহাসকে ধরতে। যেমন, তাঁর প্রতিপাদ্য হল, আধুনিক ভারতের লবি করার নিয়ম তৈরি করে গিয়েছেন জি ডি বিড়লা। তাঁর দাবি, এবং সেটা ঠিকও, ভারতের শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরা সরাসরি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই পছন্দ করে এসেছেন। কোনও পেশাদার সংস্থাদের দিয়ে নিজেদের স্বার্থের পক্ষে ওকালতি করার মধ্যে কোথাও একটা ঝুঁকির ছোঁয়া দেখতেন তাঁরা। জি ডি বিড়লা যদি লবির নিয়ম তৈরি করে দিয়ে গিয়ে থাকেন তা হলে তাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ধীরুভাই অম্বানি। তিনি নিজে এক সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন যে ভারতে ব্যবসা করে টিকে থাকতে হলে আগে সরকারকে নিজের চিন্তা বিক্রি করতে হবে।
অম্বানির ইঙ্গিত পরিষ্কার আগে সরকারকে ভজাও তার পরে বাজার। তাই যদি হয় তা হলে লবিকে ব্রাত্য করে রাখলে সমস্যা তো বাড়বে বই কমবে না। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো আইন করে ‘লবি’র ব্যাপারে স্বচ্ছতা আনার কথা ভাবা যায়, তা হলে কি খারাপ হবে? সব আইনই তো ‘লবি’ নিয়ন্ত্রিত। তা হলে যদি কেউ কোনও মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর স্বার্থ ব্যক্ত করে তা জানিয়েই হোক না। আসলে সব সামাজিক ব্যবস্থাতেই ‘লবি’ তো দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। মায়ের কাছে ছেলের বায়না। সে-ও তো লবি করা-ই! তা হলে যাঁরা আইন করেন তাঁদের সঙ্গে এই খেলাটি কী ভাবে পরিচালিত হবে, সেটা যদি আইন করে নির্দিষ্ট করা হয়, গোটা ব্যাপারটা অনেক স্বচ্ছ হয়। সুগতবাবু অবশ্য এর কোনও স্পষ্ট দিশা দেননি। কিন্তু আমরা কি এখনও ভাবব না?

ইনফ্লুয়েন্সিং ইন্ডিয়া: লবিয়িং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’স লার্জেস্ট ডিমক্র্যাসি, সুগত হাজরা (ব্রিজিং বর্ডারস প্রকাশিত)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.