|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
মনসবদারি ব্যবস্থা আজও সগৌরবে চলছে |
এক এক জায়গার এক এক জন রাজা। কখনও তিনি ব্যক্তি, কখনও তিনি বিভাগ, কখনও তিনি
কাউন্সিল। তাঁর ইচ্ছাতেই কর্ম, শুধু সম্রাটকে খুশি রাখতে পারলেই হল। পশ্চিমবঙ্গে এটাই নিয়ম।
সুগত মারজিৎ |
উন্নয়নের একটি অবশ্যপালনীয় শর্ত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব। অথচ সেই ব্যাপারে চরম দায়িত্বহীনতার সাক্ষী আমরা অনেকেই। গত বছরের ঘটনা। আমি যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, তারই একটি নতুন বাড়ি তৈরির ব্যাপারে ফায়ার ডিপার্টমেন্টের শংসাপত্র জোগাড়ের সময় আইনমাফিক সব কাগজ থাকা সত্ত্বেও এবং বারবার ‘এটা সরকারি কাজ’ বলা সত্ত্বেও আমাদের উৎকোচ দিতে বাধ্য করা হচ্ছিল। এটাই নিয়ম। অর্থাৎ, কাজ যা-ই হোক না কেন, বেআইনি হলে তো কথাই নেই, উৎকোচ দিলেই সব কাজ হাসিল। ২০১০ সালে, কলকাতা পুরসভায় ‘কর দিতে চাই, আমাকে করের বিল দিন’ এই বলে মাথা খুঁড়তে বাকি রেখেছিলাম। শুনলাম ‘বিল’ বার করতেও টাকা দিতে হয়। যা-ই হোক, মিউনিসিপাল কমিশনারের হস্তক্ষেপে ব্যাপারটি নিষ্পত্তি হয়। আজ শুনেছি খানিকটা সুরাহা হয়েছে, তবে নিয়ম-কানুনকে নয়-ছয় করার প্রবৃত্তির কী হয়েছে তা বলা শক্ত।
রাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব এবং তজ্জনিত হস্তক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্মগুলো ঠিক ভাবে চলার জন্য যে-আইন প্রণীত হয়েছে, যে-নিয়ম বলবৎ হয়েছে, সেগুলো ঠিকঠাক পালন হচ্ছে কি না তা দেখা। শুধু দু’হাতে টাকাকড়ি বিলোনো নয়। ‘আমরি’ হাসপাতালের ঘটনা একটি সমস্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মজার ব্যাপার এই যে, শিক্ষা ক্ষেত্রেও ঠিক এই ধরনের সমস্যা প্রচুর। সেখানে হয়তো মানুষের জীবন দিয়ে এই সমস্যার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হচ্ছে না। এর একটা তাত্ত্বিক দিকও আছে।
বিগত কয়েক দশক ধরে একটি রাজনৈতিক মতবাদ এই রাজ্যে প্রচলিত ছিল। সরকার বা রাষ্ট্র, যে ভাবেই ভাবি না কেন, তারাই সব কিছু চালাবে। বাজার অর্থনীতি বা রাজনীতির উল্টো মেরুর অবস্থানই এই রাজনৈতিক মতবাদের জীবনদর্শন। তা ছাড়া, কী শিক্ষা, কী স্বাস্থ্য কোথাও নিয়ম-কানুনের কমতি ছিল না। আর প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রকে মানুষের জীবনের অন্দরমহলেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু আশ্চর্য, রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন প্রক্রিয়ার দিকে প্রায়শই কোনও নজর দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, নিয়ম যা-ই হোক না কেন, সে নিয়ম ভাঙা যাবে। বেআইনি কার্যকলাপ করার ছাড়পত্রের দু’টি দিক। একটি দিক আমরা সবাই জানি বেআইনি আয়-ব্যয়ের অর্থনীতি, উৎকোচের অর্থনীতি, তোলাবাজির অর্থনীতি। অনেকেই বলবেন ‘শুধু শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বিগত সরকারকে দায়ী করছেন কেন? এ তো সব জায়গাতেই হয়!’ কিন্তু উল্লিখিত ছাড়পত্রের অন্য আর একটি দিক আছে, যেটি পশ্চিমবঙ্গের একেবারে নিজের ব্যাপার। কী স্বাস্থ্য, কী শিক্ষা গল্পটা একই। এই ছাড়পত্রটির সঙ্গে দলতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে দ্বিমতের জায়গা নেই। |
|
দলতন্ত্রের আগুনে দগ্ধ। ঢাকুরিয়া এ এম আর আই-এর অগ্নিকাণ্ডের পর শোকস্তব্ধ আত্মীয়রা। |
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কথা জানতে পেরেছি এ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে। সেখানে নিশ্চয় মানুষ প্রাণ দিচ্ছেন না, আর কলকাতায় যা ঘটে গেল, তার তুলনায় অনেক নিরুত্তাপ সেই জগৎ। কিন্তু রাষ্ট্রের চরম অবমাননা হয়েছে প্রতিনিয়ত। দিনের পর দিন নিয়ম-কানুন লঙ্ঘিত হয়েছে। পরীক্ষায় ভীষণ খারাপ ফল করা মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন, তুলনায় যোগ্যতর প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়নি। অনেক প্রতিষ্ঠানের ভূরি ভূরি আর্থিক অবহেলার কাহিনি, উৎকোচের বিনিময়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শংসাপত্র দেওয়া, যেখানে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা দফতরকে চিঠি দেওয়ার কথা, অনুমতি চাওয়ার কথা কিছুই হয়নি। কারণ, ওগুলো না করলেও কিছু যায় আসে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক-একটি দ্বীপের মতো। তার পরিচালন ভার যাঁদেরই হোক না কেন, আসল রাশ তো আর রাষ্ট্রের হাতে থাকার কথা নয়, দলতন্ত্রই সেখানে শেষ কথা। দলের কর্ণধারেরা যদি মাথার ওপর হাত রাখেন, রাষ্ট্রের সাধ্য কি সেখানে নাক গলায়।
অন্য দিকে, রাজনীতির অনেক গালভরা শব্দ ও কথা বারে বারে ব্যবহার করা হয়েছে ওই ধরনের ব্যবস্থাকে যথার্থ প্রতিপন্ন করার জন্য। সরকার কিন্তু খতিয়ে দেখতে চাইলেই সেটা হয়ে যাবে ‘গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ’। আনন্দের কথা, আমরি-র ঘটনা নিয়ে বর্তমান সরকারকে অন্তত সেই দুর্নাম শুনতে হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক অংশীদারিত্বের এত ভয়াবহ পরিণাম বোধ হয় বিশ্বের অন্য কোথাও দেখার সুযোগ হয়নি। বেশ কয়েক বছর আগে ‘সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস, কলকাতা’-র গবেষণায় পরিষ্কার ভাবে উঠে এসেছিল যে, গ্রামের মানুষ দুর্নীতি রোধে অতটা বিকেন্দ্রীকরণ চাইছেন না। পঞ্চায়েতে রাজনীতিপ্রসূত দুর্নীতি রোধে খানিকটা সরকারি হস্তক্ষেপ এবং তজ্জনিত কেন্দ্রীকরণ চাইছেন তাঁরা। সেই কারণেই এখন বিভিন্ন জেলায় সরকারি অফিসারদের নিয়ে যে উন্নয়ন কমিটি গঠন করা হচ্ছে, তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
নতুন নিয়ম, নতুন আইন প্রয়োজন হলে নিশ্চয় প্রণয়ন করা, কার্যকর করা প্রয়োজন। কিন্তু এ রাজ্যে ভাল এবং সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত নিয়মাবলির অভাব নেই। মানেন না অনেকেই, আর জানেন মানার প্রয়োজন কী, উপর মহলে চেনা-জানা থাকলেই হল। এই উপর মহলের সংজ্ঞা যখন দলীয় রাজনীতি দিয়ে নির্ধারিত হয়, তখন চার দিকে অপশাসনের সূত্রপাত হয়। তারই ঐতিহাসিক দায় বহন করছি আমরা।
এক জন শিক্ষক নির্বাচন ঠিকঠাক না হলে অন্তত ত্রিশ বছর অনেক প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের ওপরে বিশাল দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়। তেমনি সব সময় ওই একই অধ্যাপকেরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ-কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করলে স্বজনপোষণ হবার সুবিধে অনেক। আর তার প্রায় সবটাই যদি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নির্ধারিত হয়, তা হলে নিয়মকে বস্তাবন্দি করে ফেলা যায়।
আসলে দল এবং সরকার দু’টি পৃথক প্রতিষ্ঠান। রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা দু’টি পৃথক সত্তা এবং উৎকোচ দেওয়া ও নেওয়া দু’টি ব্যাপারই গর্হিত। এগুলো সহজ সত্য। আজ বিভিন্ন জায়গায় যদি আগুন থেকে বাঁচার রীতিনীতিতে গলদ থাকা সত্ত্বেও শংসাপত্র দেওয়া হয়ে থাকে, তা হলে সেগুলো যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের সবাইকেই শাস্তি দিতে হয়, তাঁরা যেখানেই থাকুন না কেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, গণতন্ত্রের হাত ধরে এগোলে কোনও দিনই কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, জনমত সব কিছুরই একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সরকার কারও চাকরি নিয়ে নিলে তিনি হয়তো আদালতে যাবেন, সেটা তাঁর অধিকার। কিন্তু অভিভাবক হিসেবে সরকারের শাস্তি দেওয়ার অধিকার আছে। শাস্তি না দিতে দিতে সে অধিকারের কথা ভুলতে বসি আমরা।
সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করার জন্মগত অধিকার ঠিক করে দিয়েছিল রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়, এবং অন্যত্র। সরকার সেখানে মূক-দর্শক। অমুক বিভাগে বাঁ হাতের রোজগার প্রচুর জেনেশুনে আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব এবং রাজনৈতিক চাপ থাকবেই, কেউ তা এড়াতে পারেন না। কিন্তু নিয়মাবলি মোটামুটি মেনে চলবে সবাই। যা-খুশি করে পার পেয়ে যাবে, কারণ বিভাগটি, প্রতিষ্ঠানটি সরকারের। সরকারের তো কোনও স্বাধীন অস্তিত্ব নেই।
আমাদের রাজ্যে একটা মডেল চলে আসছে বহু দিন রাজনীতি থেকে সরকারকে আলাদা না করার মডেল। রাষ্ট্রকে সব জায়গায় নাক গলাতে বলা আমাদের চিন্তাবিদদের বহু দিনের অভ্যেস। রাষ্ট্রই সব উৎপাদন হোক বা বণ্টন, বা কল্যাণমূলক কাজ। রাষ্ট্রই সমাজবাদের মূল ভিত্তি। অথচ সেই রাষ্ট্রকে সত্যি সত্যি ক্ষমতাশালী করার ব্যাপারে চরম অনীহা দেখিয়েছি আমরাই। সরকার শুধু টাকাকড়ি দিয়েই ক্ষান্ত থাকবেন, তার পর সব জায়গায় গণতন্ত্রের নামে, গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে ছোট-বড় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এক-এক জায়গার এক-এক জন রাজা। কখনও তিনি ব্যক্তি, কখনও তিনি বিভাগ, কখনও তিনি কাউন্সিল। ওই মনসবদারের মতো সম্রাট এক জনই, তিনি খুশি থাকলেই হল। আমরা সবাই ঘুষ নিই, কিন্তু আমাদের কেউ কিছু বলতে গেলে ঝান্ডা নিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা, সাম্য এবং সংগঠনের নামে এক পায়ে খাড়া সবাই। অনেকে বলবেন ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে। কিছু ‘ঠগ’ বাছাই হোকই না।
বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত এ ব্যাপারে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। রাজনীতি থেকে শাসনব্যবস্থার মুক্তির কথা বলছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। কিছু কিছু জায়গায় সৎ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গত তিন দশকের ‘মডেল’ ঘাড়ে নিয়ে দৌড়তে চাইছি আমরা। যে মডেল ডজন ডজন কমিটি করে সরকার এবং শাসনব্যবস্থাকে কব্জা করে ফেলেছিল। দল আগে না সরকার আগে, রাজনীতি আগে না শাসনব্যবস্থা আগে এই বিতর্কগুলো অনেক দিন ধরেই মৃতপ্রায়। এগুলোকে সামনে নিয়ে আসা এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। আপনি তমুক ইউনিয়ন করেন? যা খুশি করুন, উৎকোচ গ্রহণ করুন বা যোগ্য লোকদের শিক্ষক হতে না দেন, কিছু যায় আসবে না। অমুক দাদা তো আছেন, ঝামেলা হলে তিনি দেখবেন। যে রাষ্ট্র বহু কাল যাবৎ ধৃতরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, তার চোখে একটু আলো ফুটবে, এই বিশ্বাস সম্বল করেই এগোতে হবে।
|
কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত। |
|
|
|
|
|