স্টকহোম-এর আলোকিত মঞ্চে উঠিবার সময় টমাস সার্জেন্ট কি আত্মতৃপ্ত হইয়াছিলেন? যদি হইয়া থাকেন, তাঁহাকে দোষ দেওয়ার নহে। অর্থশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার তাঁহার তত্ত্বকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়াছে বটে, কিন্তু সেই তত্ত্বের অপরিহার্যতা বাজার বহু পূর্বেই স্বীকার করিয়া লইয়াছে। শিল্পমহলের তীব্র যাচনা সত্ত্বেও ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে সুদের হার কমাইল না, তাহাও কি র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস-এর নীতি মানিয়াই নহে? আপাতদৃষ্টিতে বোধ হইবে, ইহা যুক্তির বিপরীত কাজ। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন কমিয়া গিয়াছে, বিনিয়োগে ভাটা বাজারের আবেগ বলিতেছে, ব্যাঙ্ক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ক্রমাগত সুদের হার বাড়াইয়া যাওয়ার ফলেই বাজারের এমন অবস্থা। ঠিক এই কারণেই শিল্পমহল দাবি করিয়াছিল, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাক। ব্যাঙ্ক যদি সেই দাবি মানিয়া লইত? বাজারে হয়তো বার্তা পৌঁছাইত, রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরও হাঁটু কাঁপিতেছে। যে বাজারে আস্থার অভাবই বৃহত্তম সংকট, সেই বাজারে এই বার্তা মারাত্মক হইতে পারে। ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাইলে বাজার তাহাতে এই বার্তাটি পড়িয়া লইতে পারিত যে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও বেলাগাম হইবে, ফলে বিনিয়োগ আর বিপজ্জনক হইয়া উঠিবে। বাজার এই কথা ভাবিলে তাহার বিপ্রতীপ প্রভাব বিনিয়োগের হারে পড়িতেই পারিত। তাহাতে বিষম ফল হইত। ব্যাঙ্ক এই কথাটি সম্ভবত উপলব্ধি করিয়াছে। কোনও কথা না বলিয়াও যে অনেক কথা বলিয়া যাওয়া যায়, ব্যাঙ্ক তাহা সম্যক বুঝিয়াছে। মূল্যস্ফীতি এখনও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে নাই, কিন্তু এই দফায় আর ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়ায় নাই। ইঙ্গিতটি স্পষ্ট ব্যাঙ্ক বাজারের দিকে নজর রাখিতেছে, এবং বৃদ্ধির হারের স্বার্থে পদক্ষেপ করিতেই পারে। সুদের হার না কমানোও একটি বার্তা এখনই দিশাহারা হইবার কোনও কারণ নাই, পরিস্থিতি ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণেই আছে। বাজারকে নিরুদ্বেগ রাখিতে বার্তাটি জরুরি।
প্রত্যাশাই বাজারের মূল চালিকাশক্তি। কোনও বিনিয়োগকারী যখন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত করেন, তখন তাঁহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটি প্রত্যাশা থাকে। লাভ-ক্ষতির প্রত্যাশা নহে, বাজারের চলন সম্বন্ধে প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশায় সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূমিকাটি এই প্রত্যাশার প্রেক্ষিতে দেখিতে হইবে। আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার দাম পড়িয়া যাওয়ায় এক দফা সংকট সৃষ্টি হইতেছিল। ব্যাঙ্ক দুইটি সিদ্ধান্ত করিল নিজে কিছু ডলার বাজারে বিক্রয় করিবে; ডলারের অগ্রিম বাণিজ্যে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হইবে। সিদ্ধান্ত দুইটির মূল উদ্দেশ্য বাজারকে এই সংকেত দেওয়া যে ব্যাঙ্ক পরিস্থিতির উপর নজর রাখিতেছে। সিদ্ধান্তের পর টাকার দাম খানিক হইলেও বাড়িয়াছে। এই প্রেক্ষিতে দেখিলে ব্যাঙ্কের এখনই সুদ না কমাইবার সিদ্ধান্তটি যথার্থ। কিন্তু, দীর্ঘমেয়াদে পরিস্থিতির উপর নজর রাখিতে হইবে। বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করা প্রয়োজন যে সরকার তাঁহাদের সঙ্গেই আছে। ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির গতি যে প্রত্যাশার তুলনায় শ্লথ হইয়া পড়িতেছে, তাহা এখন সংশয়াতীত। দেখিতে হইবে, ইহাই যেন পাকাপাকি অবস্থা না হইয়া দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ইউরোপ ধুঁকিতেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও তথৈবচ। এমনকী, চিনেও উৎপাদনের গতি খানিক হ্রাস পাইয়াছে। এই পরিস্থিতির ঝাপটা ভারতেও নিঃসন্দেহে লাগিবে। কিন্তু, অভ্যন্তরীণ কারণে তাহা যাহাতে দুঃসহ না হইয়া উঠে, তাহা সুনিশ্চিত করিতে হইবে। সেই দায়িত্ব সরকারের। |