উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জঙ-ইল-এর মৃত্যুর কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষিত হইয়াছে। সেই সঙ্গে ঘোষিত হইয়াছে তাঁহার উত্তরসূরি হিসাবে পুত্র কিম জঙ আন-এর নামও। কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত উত্তর কোরিয়ায় ‘মহান নেতা’ কিম ইল সুঙ, ‘প্রিয় নেতা’ কিম জঙ-ইল হইয়া ‘মহান উত্তরাধিকারী’ কিম জঙ-উয়ান অবধি বিস্তৃত পারিবারিক শাসনের ৬৩ বছর পূর্ণ হইল। এই পিতৃতান্ত্রিক পরম্পরা আরও দীর্ঘায়িত হইবে কিনা, তাহা নির্ভর করিবে উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক ও সামরিক আমলাতন্ত্র এবং কিম পরিবারের অপর সদস্যরা মহান উত্তরাধিকারীর কর্তৃত্ব শিরোধার্য করিয়া লইবেন কিনা। কোরীয় জনসাধারণের এ ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা নাই, কখনও ছিলও না। তাঁহারা কেবল মহান নেতার মর্মরমূর্তির সামনে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া ভাসাইবেন, জাতীয় টেলিভিসন নেটওয়ার্ক মারফত যাহাতে সেই শোকসাগরের ঢেউ বিশ্বময় পাঠাইয়া দেওয়া যায়।
উত্তর কোরিয়া এমন এক কমিউনিস্ট একনায়ক শাসিত রাষ্ট্র, যাহা কেবল প্রতিবেশী চিনের ভরসায় আজন্ম বিচ্ছিন্নতার অনুশীলন করিয়া আসিতেছে। নিঃসঙ্গতা ও আন্তর্জাতিক একঘরে দশা তাহার অভিপ্রেত নিয়তি থাকিয়াছে। কোরীয় যুদ্ধের পর দ্বিখণ্ডিত এই ভূভাগের উত্তরাংশ সর্বদা দক্ষিণাংশের সহিত দ্বন্দ্বে লিপ্ত। দক্ষিণকে গ্রাস করিয়া উত্তরের অঙ্গীভূত করার অপপ্রয়াস মার্কিন অবরোধে বানচাল হওয়া ইস্তক দুই দেশের সীমান্ত বরাবর দশ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে কিম পরিবার। সেই হইতে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত লাগিয়াই আছে। আবার উভয় দেশেরই জনসাধারণের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে মাঝেমধ্যে দুই ভূখণ্ডের প্রেসিডেন্ট শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হইয়া ঐক্যের আলোচনা করেন। তবে আলোচনা কখনও সাধনায় পরিণত হয় না। দক্ষিণ কোরিয়া ধনতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি অনুশীলন করিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নবীন আর্থিক শক্তিতে পরিণত, আর কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়া দরিদ্র, অনগ্রসর। তৎসত্ত্বেও বৃহৎশক্তি হইবার, নিদেনপক্ষে বিশ্বের বৃহৎশক্তিগুলির সহিত দরকষাকষি করিবার মানসে কিম জঙ ইলের কোরিয়া পরমাণু বোমা বানাইতে তৎপর হইয়া ওঠে। পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির প্রবল চাপ এবং পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক অবরোধে সেই তৎপরতা অংশত ধাক্কা খাইয়াছে। তবে পরমাণু বোমা ব্যবহারের হুমকি দিয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে নতজানু করার চেষ্টায় ঘাটতি নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গত ভাবেই পিয়ংইয়ংকে একটি ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ রূপে শনাক্ত করিয়াছে। কিম জঙ-ইল-এর বিদায় দুইটি সম্ভাবনার দরজা উন্মোচিত করিয়াছে। এক, ‘মহান উত্তরাধিকারী’ তাঁহার কর্তৃত্ব দল, সরকার ও সেনাবাহিনীর উপর কায়েম করিতে ব্যর্থ হইলে কোরীয় উপদ্বীপে অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি হইতে পারে। দুই, তিনি উত্তর কোরিয়াকে উন্নয়ন ও উদারনীতির পথে লইয়া যাইতে পারেন, তাঁহার পিতা কিংবা পিতামহ যাহা করেন নাই। সে ক্ষেত্রে পিতার মৃত্যু এবং তাঁহার ক্ষমতারোহণ কোরিয়ার কাছে একটি সুযোগ হইয়া উঠিতে পারে। রাজনৈতিক সংস্কারের সুযোগ, অর্থনৈতিক উদারীকরণের সুযোগ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ। দক্ষিণ কোরিয়ার সহিত সহযোগিতা এমনকী মিলনের সম্ভাবনাও তখন উজ্জ্বল হইতে পারে। সোল-এর শাসকরা কিন্তু পিয়ংইয়ং-এর প্রতি বিরূপ বা বিমুখ নন। কিন্তু সে জন্য কিম জঙ-আন ও তাঁহার পারিষদদের কমিউনিস্টসুলভ অহমিকা ত্যাগ করিতে হইবে। দক্ষিণ কোরিয়া তাহার গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি পরিহার করিয়া উত্তরের অধীন হইবে, এমন আকাশকুসুম কল্পনা লালন না করাই শ্রেয়। পরমাণু বোমা বানাইবার সাধনা হইতেও নিরস্ত হওয়া দরকার। সে জন্য যে সম্পদ অপচয়িত হইতেছে, দারিদ্র দূরীকরণের কাজে তাহা নিয়োজিত হইলে দেশেরই মঙ্গল। |