ঢাকুরিয়ার আমরি-কাণ্ড বা মগরাহাটে বিষমদে মৃত্যুর ঘটনার ক্ষত না-শুকোতেই তিলজলার আগুন। যা ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বিপদের সম্ভাবনা সত্ত্বেও পুর-প্রশাসন কী ভাবে কার্যত চোখ বুজে ছিল। অগ্নিকাণ্ডের পরে রাজ্যের মন্ত্রী থেকে পুলিশকর্তা বা আমলা সকলেই স্বীকার করছেন, সাদা চোখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে গাদাগাদি করে গজিয়ে ওঠা বাড়িগুলির পুর-ছাড়পত্র থাকার কথা নয়। এই অগ্নিকাণ্ডে তাই আরও এক বার বেআব্রু তিলজলা-তপসিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘জতুগৃহ’-এর চেহারাটা।
ঘিঞ্জি অলিগলিতে পুর-আইনের তোয়াক্কা না-করে সার সার চার-পাঁচতলা বাড়ি। গৃহস্থের ঘরের পাশেই ভাড়া করা ফ্ল্যাটে জুতো বা রঙের ‘বেআইনি’ কারখানা। এক-একটি ফ্ল্যাট তথা কারখানায় ৫০-৬০ জনের ভিড়। সোমবার রাতে সি এন রায় রোডে এমনই একটি বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের মোকাবিলায় একটানা ১৫ ঘণ্টা হিমশিম খায় দমকল।
|
বস্তুত, কয়েক বছর আগে ওই এলাকার কাছে কুষ্টিয়া রোডের একটি বাড়িতে রঙের কারখানায় আগুন লেগে একসঙ্গে ১২ জন পুড়ে মারা যান। এ যাত্রায় অবশ্য বাড়ি ফাঁকা থাকায় কেউ হতাহত হননি। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা স্বীকার করছেন, অগ্নিনির্বাপণের ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেই কোথাও। তাই কার্যত প্রাণ হাতে নিয়েই ব্যবসা করেন তাঁরা। কারখানার জন্য দমকলের ছাড়পত্র নেওয়াও এ তল্লাটের দস্তুর নয়। কোনও ঘটনা ঘটলে প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। ফের যে-কে সে-ই। ঠিক যেমনটা রাজ্যের চোলাই-ঠেকগুলোর ক্ষেত্রে ঘটে থাকে।
তিলজলার অগ্নিকাণ্ডের পরে প্রশাসনের তাৎক্ষণিক ‘তৎপরতা’ অবশ্য শুরু হয়েছে। ছ’মাস আগে বিধানসভা ভোটে কসবা কেন্দ্রে দাঁড়ানোর আগেও যিনি এই এলাকার বিধায়ক ছিলেন, সেই জাভেদ খানই এখন রাজ্যের দমকলমন্ত্রী। ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি বলেন, “এলাকার কারখানাগুলোর দমকলের ছাড়পত্র আছে কি না, ১৫ দিনের মধ্যে দেখাতে বলা হয়েছে।” এই বাড়িগুলির নির্মাণ আইনসিদ্ধ কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে পুরসভা।
আগুন লাগার পরে সোমবার রাতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। মঙ্গলবার তিনি বলেন, “সরু সরু গলিতেও দু’-চারতলা বাড়ি তৈরি হয়েছে। সেগুলি যে বৈধ নয়, সেটা পরিষ্কার। কী ভাবে এ সব বাড়ি গড়ে উঠল, তা দেখা দরকার। ওই সব বেআইনি বাড়ি ও কারখানার ব্যাপারে পুরসভাকে সক্রিয় হতে হবে।” স্থানীয় বাসিন্দাদের অবশ্য অভিযোগ, পুরকর্মীদের একাংশের হাতে মোটা টাকা দিয়েই ওই সব বেআইনি বাড়ি গড়ে উঠেছে।
|
কারখানায় ঢোকার পথে এ ভাবেই
মজুত
থাকত নানা দাহ্য বস্তু। |
প্রশাসনের চোখের সামনে তিলজলা-তপসিয়ায় কী ভাবে গজিয়ে উঠল এতগুলি বেআইনি বাড়ি?
দমকলমন্ত্রীর যুক্তি, ৩৪ বছরের বাম-জমানাতেই এই তল্লাটে বেআইনি বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। তাঁর কথায়, “তিলজলা ও তপসিয়া আগে কারখানা এলাকা (ইন্ডাস্ট্রি জোন) ছিল। পরে জনবসতি গড়ে উঠেছে। এখন ওই এলাকা থেকে জুতো তৈরির কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নিলে স্থানীয় বাসিন্দাদের বসবাসের সুবিধা হবে।” স্থানীয় বাসিন্দা মুর্শেদ, হুসেন, খুরশিদদের কিন্তু দাবি: রাজনৈতিক নেতারা মুখে কারখানা সরানোর কথা বললেও বাস্তবে নিজেদের ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা’ থেকেই পিছিয়ে যান।
দমকল সূত্রের খবর, তিলজলার সরু গলিতে ঢুকে কারখানার আগুন নেভাতে রীতিমতো বেগ পেতে হয় তাদের। গোটা রাত আগুন আয়ত্তে আনা যায়নি। এলাকাবাসী আশঙ্কায় ছিলেন, পাশের বাড়িগুলিতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ দিন সকালেও পরিস্থিতি হাতের বাইরে থাকায় একটা সময়ে নন্দরাম-কাণ্ডের ছায়া দেখছিলেন দমকলের কর্তারা। ২০০৮ সালে ওই বহুতল বাজারে আগুন নেভাতে লেগে গিয়েছিল পাক্কা তিন দিন।
তিলজলার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে এ দিন দুপুরেরও পরে। কী ভাবে আগুন লেগেছিল, তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত নন দমকল-কর্তৃপক্ষ। যদিও কারখানার ঘরময় দাহ্য পদার্থ মজুত থাকার কথা জানিয়েছেন তাঁরা। তবে আগুন নিভলেও বাড়িটিতে ফাটল ধরায় তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় এলাকায় আতঙ্ক বাড়ছে।
|