অর্ডিন্যান্সে যা ছিল, বিলে তা নেই এই যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়া বিল নিয়ে প্রশ্ন তুললেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। তাঁর ‘আপত্তি’ মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটিতে উপাচার্যকে ‘নিয়োগকর্তা’ না-করা নিয়ে। অর্ডিন্যান্সে উপাচার্যকে ‘নিয়োগকর্তা’ রাখা হয়েছিল। বিলে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ‘এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিল’কে (কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যেমন ‘সিন্ডিকেট’)।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজ্যপালের ‘ইচ্ছা’ মেনে নিয়েই প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার শর্তে বিলটি আগামী শুক্রবার বিধানসভায় আনা হচ্ছে। আজ, মঙ্গলবার প্রস্তাবিত বিলটি বিধায়কদের দেওয়া হবে।
বিল নিয়ে রাজ্যপালের এ হেন ভূমিকায় ‘ক্ষুণ্ণ’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে এখনই তিনি রাজ্যপালের সঙ্গে কোনও রকম সংঘাত চান না (বস্তুত, মমতার মাতৃবিয়োগের পর সোমবার তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল)। তবে প্রাথমিক ভাবে ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী অভিমত দেন, মন্ত্রীরা যেন রাজ্যপালের ‘পরামর্শ’ অনুযায়ীই বিলে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে নেন। মন্ত্রীরাও মুখ্যমন্ত্রীর কথা মেনে নেন। সেই মতোই যে বিল তৈরি হয়েছে, তাতে সরাসরিই বলা হয়েছে, ‘বিলের কিছু কিছু ধারা সংশোধন করা এবং কিছু নতুন সংস্থান করা দরকার’। সরকার পক্ষের সূত্রের খবর, যে সংশোধনীগুলি বিল পেশের দিন আনা হবে, সেগুলি তখনই সভায় পড়ে দেবেন সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। |
প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালগুলির পরিচালন ব্যবস্থাকে রাজনীতির কবল-মুক্ত করতে নতুন সরকার প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স এবং পরে এই বিল আনছে। রাজ্য মন্ত্রিসভায় অর্ডিন্যান্সটি পাশ হয়ে গিয়েছিল আগেই। রাজ্যপালের ‘সম্মতিক্রমে’ বিধানসভায় বিলটি পাশ হলেই তা আইন হয়। কিন্তু বিল পেশের আগে রাজ্যপাল তা নিয়ে ‘আপত্তি’ তোলায় সরকার পক্ষ ঈষৎ ‘বিব্রত’। তৃণমূলের একাংশের অবশ্য অভিমত, বাম আমলের দলতন্ত্রকে বিদায় দিয়ে শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ‘পরিচ্ছন্ন’ করতে যে অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছিল, সেখানে ওই বিষয়টি নিশ্চিত হলেও প্রস্তাবিত বিলে তা রক্ষিত না-হয়ে ‘অন্য রকম’ দলতন্ত্রের সুযোগ থাকছিল বলে মনে করায় রাজ্যপাল ‘পদ্ধতিগত আপত্তি’ তুলেছেন। কিন্তু আদতে তাঁর ‘ইঙ্গিত’ দলতন্ত্রের ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ দিকেই। তবে সরকার পক্ষ তাঁর ‘পরামর্শ’ মেনে নিয়েছে।
সোমবার রাজ্য মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “কিছু সংশোধনী-সহ বিশ্ববিদ্যালয় বিলটি আগামী শুক্রবার সভায় পেশ করা হবে।” এর বাইরে তিনি ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। বিশদে মন্তব্য করতে চাননি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও। তবে তিনিও জানান, ‘নির্দিষ্ট সময়েই’ বিলটি বিধানসভায় পেশ করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় বিল নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে সরকারের ‘যুক্তির লড়াই’ শুরু রবিবার দুপুরে। তার আগে শনিবার রাতেই সরকারের কাছে খবর যায়, রাজ্যপাল ওই বিলের কিছু বিষয় মানতে রাজি নন। তিনি সরকারের কাছে নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা চান। ঠিক হয়, রবিবার দুপুরে রাজভবনে তাঁকে ‘ব্যাখ্যা’ দিতে যাবেন ব্রাত্য বসু। সঙ্গে যাবেন সুব্রতবাবু। সেই মতো তাঁরা রাজভবনে যান। এক ঘণ্টারও বেশি সময় তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাজ্যপাল। বিলের বিভিন্ন ধারা ধরে ধরে আলোচনা হয়। তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত ধারা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলেন রাজ্যপাল।
তিনি মূলত যা বলতে চান, তা হল বিল আসার আগে যে অর্ডিন্যান্স তৈরি হয়েছিল, সেখানে শিক্ষকদের ‘নিয়োগকর্তা’ হিসেবে উপাচার্যকে রাখার সংস্থান ছিল। এই নয়া বিধি আনার আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষক নিয়োগ করত সিন্ডিকেট, তেমনই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা করত এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিল। অর্ডিন্যান্সে এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিলের জায়গায় উপাচার্যকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হলেও বিলে আবার এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিলকেই ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সিলেকশন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর নিয়োগ করবে’।
সেখানেই আপত্তি তোলেন রাজ্যপাল। তাঁর বক্তব্য, যদি কোনও কারণে এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিল দীর্ঘদিন কাজ করতে না-পারে (রাজ্যপালই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ দেন), তা হলে শিক্ষক নিয়োগ কি আটকে থাকবে? কে তাঁদের নিয়োগকর্তা হবেন? উপাচার্যকে নিয়োগকর্তা হিসেবে রাখা হলে প্রয়োজনে নয়া বিলের সংস্থান অনুযায়ী উপাচার্য বদলও করা যায়। তাতে কাজও আটকায় না। কিন্তু রাতারাতি এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিল তো আর বদলে ফেলা যায় না! রাজ্যপালের প্রশ্ন এই বিবেচনায় উপাচার্যকে নিয়োগকর্তা হিসেবে রাখার যে সংস্থান অর্ডিন্যান্সে ছিল, বিলে কেন তা রাখা হচ্ছে না?
সরকার পক্ষের তরফে রাজ্যপালকে বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষেই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল। তবে রাজ্যপালের আপত্তি থাকলে তিনি যেমন বলছেন, সেই মতো বিলটির সংশ্লিষ্ট ধারাগুলিকে সংশোধন করে নেওয়া হবে। কিন্তু মূল বিলটি এই অধিবেশনে পেশ করা না-গেলে বিভিন্ন ‘জটিলতা’ দেখা দেবে। কারণ, অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বিলটি পেশ এবং পাশ না-হলে সেই সিদ্ধান্তগুলিও ‘খারিজ’ করে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে একটা সার্বিক জটিলতার আশঙ্কা থাকছে। রাজ্য মন্ত্রিসভার এক সদস্যের কথায়, “এই বিল পাশ না-হলে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে, তা যেমন বিঘ্নিত হবে, তেমনই বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেস্ট্রোস্পেক্টিভ এফেক্ট (পূর্বাপর প্রয়োগ) করতে হবে। এত দূর এসে সেটা করা কঠিন।”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মূল আপত্তির পাশাপাশি দু’টি কমিটির সদস্য সংখ্যা নিয়েও আপত্তি তোলেন রাজ্যপাল। তিনি সদস্য সংখ্যা কমিয়ে দিতে বলায় সরকার পক্ষ তাতেও ‘রাজি’ হয়। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “রাজ্যপালের মূল আপত্তিটি গুরুতর ছিল। বাকিগুলি ততটা নয়।”
বৈঠকে ঠিক হয়, সোমবার বিলটি নিয়ে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিধানসভায় আলোচনায় বসবেন সুব্রতবাবু এবং ব্রাত্য। রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠকে আরও ঠিক হয়, বিলটি বিধানসভার চলতি অধিবেশনের শেষ দিন, শুক্রবার পেশ করা হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সেটি তার অন্তত দু’-তিন দিন আগে বিধায়কদের মধ্যে বিলি করতে হবে। মঙ্গলবারের মধ্যে বিধায়কদের বিলটি না-দিলে তা শুক্রবার সভায় পেশ করা যাবে না। সে জন্য রাজ্যপালের ‘সম্মতি’ প্রয়োজন। কিন্তু রাজ্যপাল সোমবার বিকেল থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত তাঁর পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচিতে শহরের বাইরে থাকবেন। ফলে সংশোধনীগুলি ঢুকিয়ে ‘সংশোধিত’ বিল ছাপিয়ে এনে রাজ্যপালের ‘সম্মতি’ জোগাড় করা হয়ে উঠবে না। রাজ্যপাল তখন মন্ত্রীদের জানান, সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় সংশোধনীগুলি আনা হবে, এই ‘আশ্বাসে’ তিনি রবিবারই ‘সম্মতি’ দিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর বিশ্বাস, সরকার পক্ষ সংশোধনী এনে অবস্থা সামাল দিতে পারবে। সেই মতোই ৭১ পৃষ্ঠার বিলটি ছাপানো হয়েছে এ দিন। যার ৭০তম পৃষ্ঠায় বিলের কিছু বিষয়ে সংশোধনী আনা এবং কিছু বিষয়ে সংস্থান রাখার ‘প্রয়োজনীয়তা’র কথা বলা হয়েছে। |