বর্ধমান শহরের ১৭ জন নেতাকে জোনাল ও চারটি লোকাল কমিটি থেকে সরিয়ে দিল সিপিএম। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সুজিত ঘোষ, সুবীর রায়, সুনির্মল ওরফে কাল্টু নন্দী, রবিশঙ্কর পাল, দুর্র্গাশিব রায়, অধিক্রম সান্যাল, মৃদুল সেন প্রমুখ। দলের মধ্যে বিতর্ক এড়াতে শেষ তিন জনকে অবশ্য জোনাল কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য করা হয়েছে।
সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য তথা প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন বর্ধমান দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে হেরে যান। কেন্দ্রটি বর্ধমান শহর জোনাল কমিটির অন্তর্ভুক্ত। সেই কারণে দলের একাংশ মনে করছেন, বিধানসভা নির্বাচনে নিরুপমবাবুর পরাজয়ের জেরে এই ১৭ জনকে কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। পার্টি নেতৃত্ব অবশ্য তা মানতে চান নি। জোনাল কমিটির পুনর্নির্বাচিত সম্পাদক তাপস সরকার বলেন, “এটা আমাদের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি সম্মেলনেই কেউ না কেউ বাদ পড়েন। তাঁদের জায়গায় আবার নতুন করে অন্য কাউকে নেওয়া হয়। তাই হয়েছে।”
দলের শহর-২ নম্বর লোকাল কমিটি থেকে যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, তমাল চট্টোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, স্বপন চক্রবর্তী, সামিনুর রহিম ওরফে সেনা। দলীয় সূত্রে খবর, এই চার জনই বর্তমানে এলাকা ছাড়া। শুধু এঁরাই নন, মোট ১৯ জন দলীয় সদস্য ‘তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের আক্রমণে’ শহর ছাড়া বলে প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে। জোনাল সূত্রের খবর, দলীয় নেতৃত্বকে কিছু না জানিয়ে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের দিন শহর ছেড়েছিলেন দু’জন জোনাল সদস্য এবং কয়েক দিন পরে আরও এক জন। তবে সেই কারণেই যে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, নেতৃত্ব সে কথা মানতে নারাজ।
বিভিন্ন কমিটি থেকে ১৭ জন নেতাকে বাদ দেওয়ার ঘটনায় দলের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কেন এই ১৭ জনকে তাঁদের বাদ দেওয়া হল, তা নিয়ে জেলা পার্টি কোনও স্পষ্ট জবাব দেয়নি। অন্য দিকে, জোনাল স্তরের কয়েক জন নেতার অভিযোগ, “দলের কর্মী-সমর্থকেরা যখন তৃণমূলের আক্রমণের মুখে পড়ছেন, তখন তাঁদের পাশে নেতৃত্বের একাংশ দাঁড়াচ্ছেন না। তাঁরা ফোনেই খবর নিয়ে কাজ সারছেন। আর যাঁরা পাশে দাঁড়াতে পারতেন, সেই লড়াকু নেতাদেরই বাদ দেওয়া হয়েছে!” অর্থাৎ দলের একাংশ মনে করছেন, কমিটি থেকে যাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ‘লড়াকু’ নেতা।
নিরুপমবাবুর পরাজয় যে দলের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল জোনাল কমিটির খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনে তা স্বীকার করে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রায় ৩৭ হাজার ভোটে বামপন্থী প্রার্থীর পরাজয় ঘটবে, এটা আমাদের কেউ বুঝতে পারেননি। বর্ধমান শহরে পার্টির সর্বকালীন সবচেয়ে কম ভোট যা হল, শতকরা ৩৭.৮৯ শতাংশ। সংখ্যায় ৭০৬০৪। পার্টির সমর্থনের এই ধসের আগাম অনুমান করা সম্ভব হয়নি। সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে পারা যায়নি।’ কেন পার্টি ব্যর্থ হল, সেই ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন কর্মসূচিতে আমাদের সমর্থক পরিবারের লোকজনদের সংগঠিত করা গেলেও তার বাইরের একটা ভাল অংশের মানুষের কাছে আমরা পৌঁছতে পারিনি।.........সাঁইবাড়ি নিয়ে বিরোধীদের প্রচারের প্রভাবে যে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন, তাও বোঝা সম্ভব হয়নি। এই কুৎসা, অপ্রপ্রচারের মোকাবিলা করার মত নিবিড় প্রচার করাও যায়নি।’
বহু প্রচারিত স্বাস্থ্য উপনগরী গড়ে তোলার ব্যর্থতাও যে নিরুপমবাবুর পরাজয়ের অন্যতম কারণ, রিপোর্টে তাও স্বীকার করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘হেল্থ সিটিকে ঘিরে যুবকদের মধ্যে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা রূপায়িত না হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই এই অংশের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নেতৃত্ব ও পার্টি কর্মীদের একাংশের ভাবমূর্তি, গ্রহণযোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সঞ্চারিত করেছে। বারবার বলেও কিছু কাজ না হওয়ায় ও পার্টি সংগঠনের অসহায়তা লক্ষ করে, মুখে কিছু না বলে তার বহিঃপ্রকাশ অনেকেই ব্যালটে দেখিয়েছেন।’ ভোটের দিন যে শহরের অধিকাংশ বুথ তৃণমূল কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করেছে তা স্বীকার করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনের দিন আমাদের কর্মীরা অনেক ক্ষেত্রেই বুথ কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেছেন।’ |