দীর্ঘ অসুস্থতার পরে শনিবার প্রয়াত হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা গায়ত্রীদেবী (৮১)। এ দিন সকাল ৮টা ৩৫মিনিটে এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে তাঁর জীবনাবসান হয়।
দীর্ঘদিন ধরেই কিডনি জনিত অসুখে ভুগছিলেন গায়ত্রীদেবী। গত ২৫ নভেম্বর তাঁকে এসএসকেএমে ভর্তি করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী সে দিন দিল্লিতে ছিলেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় গায়ত্রীদেবীর অবস্থা অতি সঙ্কটজনক হওয়ার সময়েও তিনি দিল্লির একটি অনুষ্ঠানেই ছিলেন। মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর পেয়ে তিনি দিল্লি-সফর কাটছাঁট করে বেশি রাতের উড়ানে কলকাতায় ফিরে আসেন। বিমানবন্দর থেকে সোজা এসএসকেএমে যাওয়ার পর রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত মায়ের কাছেই ছিলেন মমতা।
মাতৃবিয়োগের ফলে শনি, রবি এবং সোমবার মুখ্যমন্ত্রী ‘গুরুদশা’ কাটাতে বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরি-কাণ্ডে ‘দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি’ ও বিষমদ কাণ্ডের বিরুদ্ধে ‘জনমত গড়ে তুলতে’ এ দিন বিকেলে কলকাতায় তৃণমূলের যে দু’টি মিছিল হওয়ার কথা ছিল, প্রত্যাশিত ভাবেই তা স্থগিত রাখা হয়েছিল।
|
গায়ত্রীদেবী। |
আজ, রবিবার সিঙ্গুরে তাপসী মালিকের মূর্তি স্থাপনের যে নির্ধারিত অনুষ্ঠানে মমতার যাওয়ার কথা ছিল, মমতার নির্দেশে সেখানে যাবেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় এবং সাংসদ ও লোকসভায় দলের মুখ্য সচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষমদ-কাণ্ড নিয়ে কাল, সোমবার বিধানসভায় যে সর্বদলীয় বৈঠক হওয়ার কথা, সেখানেও থাকতে পারবেন না মুখ্যমন্ত্রী। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ওই বৈঠক করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। মুকুল রায়-সহ তৃণমূলের অন্য নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রীরা থাকবেন বৈঠকে।
শনিবার সকালে হাসপাতাল থেকে মায়ের মৃত্যুসংবাদ মুখ্যমন্ত্রীকে জানান দলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজি।
খবর জেনে মমতা কিন্তু শান্ত ভাবেই বাড়ি থেকে দলের বিভিন্ন স্তরে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে থাকেন। হাসপাতালে ভিড় বাড়তে থাকে তৃণমূলের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, সমর্থকদের। অগণিত মানুষ ভিড় জমান হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিটের বাড়িতেও। মায়ের মৃত্যুতে হাসপাতাল বা বাড়িতে ‘শোকের কলরব’ এড়াতে বেলা ১২ টার মধ্যেই অন্ত্যেষ্টি প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দেন মমতা। বস্তুত, দলের নেতাদের একাংশের বক্তব্য, ‘‘নিজের প্রিয়তম মানুষকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যেমন একটি বার্তা দিয়েছিলেন, তেমনই তাঁর শোক নিয়ে কোনও বাড়াবাড়ির সুযোগ না-দিয়েও তিনি একটি নজির তৈরি করলেন।” মমতা নিজে এ দিন শুধু এটুকুই বলেছেন, “মা কিন্তু আমাদের গোটা তৃণমূল পরিবারেরই মা ছিলেন।” আর বলেছেন, “মাওবাদীরা আমায় খুনের হুমকি দেওয়ার পর মা একটু চিন্তিত থাকতেন।
এখন আর ওসব চিন্তা করার কেউ রইল না!” |
গায়ত্রীদেবীর মরদেহ শববাহী শকটে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনে কয়েকমিনিট রাখার পরেই নিয়ে যাওয়া হয় কেওড়াতলা শ্মশানে। ঘরের ভিতর থেকেই একঝলক মা’কে দেখেন মমতা। তার আগেই দলের মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে তিনি ফোনে নির্দেশ দিয়েছিলেন শ্মশানে অন্ত্যেষ্টির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে রাখতে। মুকুলবাবুর তত্ত্বাবধানে বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যেই শ্মশানে পৌঁছে যায় গায়ত্রীদেবীর মরদেহ। মমতা রয়ে যান বাড়িতেই। শ্মশানে তৃণমূলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের মন্ত্রীরা, বিধায়ক-সাংসদ-কাউন্সিলররা হাজির হন। উপস্থিত হন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। যান রাজ্য সরকারের প্রথমসারির আমলারা এবং শীর্ষস্থানীয় আইপিএস-রাও। মমতা পুলিশ-প্রশাসন ও দলীয় স্তরে মন্ত্রী মদন মিত্রকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে গায়ত্রীদেবীর শেষকৃত্যের জন্য আসা মানুষের ভিড়ে অন্য শবানুগমনকারীদের অসুবিধা না-হয়। সেই মতো ভিড় সরিয়ে অন্য শববাহী শকটের রাস্তা করে দেন মদন মিত্র, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, অরূপ বিশ্বাস সহ মন্ত্রী-বিধায়করা। শ্মশানে আসেন মমতার ভাইয়েরা। তাঁদের সঙ্গে আসেন ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ এবং সল্টলেক পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী। যাঁরা গায়ত্রীদেবীর অত্যন্ত ‘কাছের মানুষ’ ছিলেন। বেলা ১টার কিছু পরে সম্পন্ন হয় অন্ত্যেষ্টি।
শ্মশান থেকে গঙ্গায় অস্থি বিসর্জন দিয়ে ভাইয়েরা বাড়িতে ফেরেন। দুপুর থেকে মায়ের ঘরেই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। গায়ত্রীদেবী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত যে বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন, তার উপর মায়ের একটি ছবি রেখে তার সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসেছিলেন মমতা। যে শয্যায় গায়ত্রীদেবী শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন, সেই চাদরটি মমতা নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছেন। ‘মা-নির্ভর’ মমতা বরাবর বাড়ি থেকে বেরনোর আগে মা’কে প্রণাম করে এবং মায়ের ‘আশীর্বাদী হাতখরচ’ ১০টি টাকা নিয়ে বেরোতেন। |
সেই সময়। গায়ত্রীদেবীকে প্রণাম করছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। মায়ের সঙ্গে মমতা। —ফাইল চিত্র |
যে টাকা জমিয়ে মমতা বাড়ির কালীপুজোয় প্রতিবছর প্রতিমার একটি করে অলঙ্কার তৈরি করিয়ে দিতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর ‘মা-নির্ভরতা’র কথা প্রকাশ্যেও বারবার বলেছেন মমতা। বলেছেন, “মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।” সব কাজেই মা তাঁর ‘প্রেরণা’ ছিলেন বলেও বার বার উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মাতৃহারা মুখ্যমন্ত্রীকে সমবেদনা জানাতে এ দিন সকাল থেকেই কাতারে কাতারে মানুষ এসেছেন তাঁর বাড়িতে। মস্কো থেকে তাঁর বাড়ির লাগোয়া দফতরে ফোন করে সমবেদনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ফোন করেছেন রাহুল গাঁধী, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী সহ অসংখ্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। দিল্লি থেকে কলকাতা পৌঁছে সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জানিয়েছেন লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার। তার ফাঁকেই অবশ্য মহাকরণ থেকে জরুরি ফাইল আনিয়ে তা দেখে দরকারি নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বাড়িতে গিয়ে মমতাকে সমবেদনা জানান প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য, কংগ্রেসের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। ব্যক্তিগত শোকের সময় রাজনীতির গন্ডি পেরিয়ে সমবেদনা জানাতে মমতার সঙ্গে দেখা করতে যান রাজ্য বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, আরএসপি-র ক্ষিতি গোস্বামী, প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ প্রমুখ। মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সমবেদনা জানিয়ে শোকবার্তা পাঠান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। এসইউসি-র নেতারাও যান মমতার বাড়িতে। সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্টজনেরাও হাসপাতাল, শ্মশানে ও মমতার বাড়িতে যান গায়ত্রীদেবীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। তাঁদের অনেকে ব্যক্তিগত শোকবার্তা পাঠান মমতাকে। ভিড়ের চাপে সাধারণ দর্শনার্থীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য মমতার বাড়িতে একটি বেদি করে দিতে হয়। সেখানেই রাত পর্যন্ত মানুষ ফুল-মালায় শেষ শ্রদ্ধা জানান মুখ্যমন্ত্রীর মা’কে। |