ক্রেমলিনে জারদের সুপ্রাচীন প্রাসাদ। আজকের ‘দুমা’ বা রাশিয়ার পার্লামেন্টের ঠিক সামনেই। ভ্লাদিমির লেনিনের সমাধি ক্ষেত্র। প্রবল শীতের মধ্যেও স্থানীয় মানুষ এখানে আসছেন। রেখে যাচ্ছেন গোলাপের তোড়া।
ক্রেমলিনের উত্তর দিকে প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। রুশ স্থাপত্যের রঙিন নির্দশন ক্যাথিড্রাল। তার বিশাল ঘড়িটা ঢং-ঢং করে এখনও বাজছে। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব জারদের উৎখাত করে এনেছিল কমিউনিস্টদের। লেনিনের পর স্টালিন, স্টালিনের পর ক্রুশ্চেভ। আর তার পর ব্রেজনেভ থেকে ইয়েলৎসিন কমিউনিস্ট যুগের অবসানের সুদীর্ঘ ইতিহাস।
কিন্তু এ বারের নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন রাশিয়ার কমিউনিস্টরা। পার্লামেন্টে তাঁদের সদস্য-সংখ্যা ৫৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯২। ‘পুতিনতন্ত্রে’ও ধাক্কা দিয়েছেন তাঁরা। আজ যাঁরা পুতিনের বিরুদ্ধে পথে পথে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অতি-বামপন্থী কিছু কমিউনিস্টও আছেন। তাঁরা আবার অভিযোগ তুলেছেন, রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি আসলে পুতিনেরই বি-টিম।
মস্কো আজ এক আজব শহর। পৃথিবীর অন্যতম ধনী শহর। প্রায় পঞ্চাশ জন কোটিপতির বাস এখানে। অথচ এই রাশিয়ারই দারিদ্র ভয়ঙ্কর হারে বাড়ছে। চাকরি নেই, খাদ্যের অভাব। অথচ এখানেই এক কাপ কফির দাম প্যারিসের চেয়েও বেশি। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র নিকোলাস ভন সারগেই দুঃখ করে বললেন বলশেভিক বিপ্লবের কী মর্মান্তিক পরিণতি! রাশিয়ার আর্থিক অসাম্য মার্কিন মুলুকের চেয়েও বেশি।
কিন্তু ১৯৯৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার যে কমিউনিস্ট পার্টি নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিল, তারা যে আরও জনপ্রিয়তা অর্জন করছে, তা এ বারের ভোটেই পরিষ্কার। ২০০৭ সালে দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ১৮১। পার্টি সদস্যদের দাবি, সেই সংখ্যাটা এখন দ্বিগুণেরও বেশি। এই কমিউনিস্ট পার্টির নেতা যুগানভ কিন্তু বদ্ধপরিকর তাঁদের দলটাকে রাশিয়ার সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সঙ্গেই মানানসই করে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আর এই যুগানভের দলের সঙ্গেই এখনও সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে প্রকাশ কারাটের সিপিএম।
মজার ব্যাপার হল, যুগানভ ঘোষণা করেছেন, তাঁদের দলের মতাদর্শগত ভিত্তি শুধু মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ নয়, তাঁরা বামপন্থী রুশ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। যুগানভ বলেছেন, আস্তিকতা বা ধর্মবিশ্বাস কোনও অন্যায় নয়। বরং তিনি মনে করেন, রুশ ঐতিহ্যে ক্যাথলিক গির্জার ভূমিকা কিছু কম নয়। পুতিন তো প্রতি রবিবার নিয়ম করে গির্জায় যান। এমনকী যুগানভকেও নাকি মাঝেমধ্যে গির্জায় যেতে দেখা যাচ্ছে। একদলীয় শাসন নয়, বহুদলীয় গণতন্ত্রই যে ভাল, তা মানতেও রাশিয়ার আজকের কমিউনিস্টদের কোনও দ্বিধা নেই। আবার খোলা বাজারের অর্থনীতিকে খোলা মনে গ্রহণ করতেও যুগানভ প্রস্তুত। মস্কোর কফি হাউসে বসে স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠনের নেতা আলেক্সি এরেনেঙ্কো জানালেন, বিদেশি লগ্নিকে স্বাগত জানিয়েছেন যুগানভ। তবে তেল ও গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেরও পক্ষে তাঁরা। এমন কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা নতুন করে জাতীয়করণের কথা বলছেন।
বড়দিনের ঠিক আগের দিন, ২৪ ডিসেম্বর পুতিন-বিরোধী বিরাট জনসভা করতে চলেছেন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভ এতটাই তুঙ্গে উঠেছে যে পুতিনকেও বলতে হয়েছে, বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর মতের পার্থক্য থাকলেও তিনি বিক্ষোভ করার ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ দিচ্ছেন। বিক্ষোভকারীরাও গাঁধীগিরি দেখাচ্ছেন মুন্নাভাইয়ের কায়দায়। তাঁরা ফুল ছুড়ছেন পুলিশের গায়ে। আর চাপের মুখে পুতিনও ইয়েলৎসিনের রাস্তা বর্জন করে গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলছেন। এই পরিস্থিতিতেও পুতিন যে ক্ষমতাতেই থেকে যাবেন, সেটা কমিউনিস্টরা জানেন। কিন্তু আগামী দিনে পুতিনকে সরিয়ে রাজনৈতিক পরিসর দখল করার লক্ষ্যেই এগোতে চাইছেন তাঁরা।
কিন্তু বিকল্প অবয়ব হিসাবে যুগানভকে কি রাশিয়ার মানুষ মানবেন? নাকি উঠে আসবে নবীনতম কোনও মুখ?
এই প্রসঙ্গে বলা যায় এ বারের সফরে দেখা আরও একটা ‘বিস্ময়কর’ ব্যাপারের কথা। কমিউনিস্টরা শুধু নন, দেশের বহু মানুষই এখন স্মরণ করছেন জোসেফ স্টালিনকে। এমন নয় যে রাশিয়ার মানুষ স্টালিনের ‘গণহত্যা’র কথা ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু সকলেই অনুভব করছেন এক শক্তিশালী রাশিয়া গড়ার প্রয়োজনীয়তা। সে কথা যেমন পুতিন বলছেন, তেমন বলছেন কমিউনিস্টরাও। আর তাই রুশদের অনেকেই মনে করছেন, শক্তিশালী রাশিয়া গড়তে চাই স্টালিনের মতো এক জন নেতা। ক্রেমলিনের ক্যান্টিনে রুশ সাংবাদিকরা একসুরে বললেন, ’৪১ সালের যুদ্ধে যখন নাৎসি বাহিনী প্রায় ক্রেমলিনের কাছে ঢুকে পড়েছিল, তখন প্রবল শীতের মধ্যেও স্টালিনই তাদের তাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজ তাঁর মতো এক জন নেতা দরকার। স্থানীয় সাংবাদিক ভ্লাদিমির রেডিউইনের আবার তির্যক মন্তব্য, “সমস্যা হচ্ছে পুতিনই বলুন বা যুগানভ কারওই স্টালিনের মতো মোটা গোঁফ নেই।” রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে ভ্লাদিমিরের বক্তব্য, “বলশেভিকদের সময়ে পেন্ডুলাম এক বার গিয়েছিল রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দিকে। আর এক বার গর্বাচভ নিয়ে গেলেন খোলা বাজারে। আর এখন যুগানভের কমিউনিস্ট পার্টি এর মাঝখানে একটা জায়গা খুঁজছে।”
পৃথিবীর প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রই কি আজ এই ‘মাঝামাঝি’ পথ, অর্থাৎ মিশ্র অর্থনীতির পথটাই বেছে নিচ্ছে? মস্কোর কমিউনিস্ট পার্টির নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখতে দেখতে একটা প্রশ্ন তোলা যায়। এ কে জি ভবনের প্রকাশ কারাট থেকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বিমান বসু তাঁরাও কি পারেন না পার্টি কংগ্রেসের আগে সময়ের দাবি মেনে দলের খোলনালচে বদলানোর সাহস সঞ্চয় করতে? ‘জাতীয়তাবাদী’ কমিউনিস্ট হতে আজও এত সংশয় কেন? রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি যদি ধর্ম থেকে বাজার সব ব্যাপারেই মুক্ত চিন্তাকে আহ্বান জানাতে পারে, তা হলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা সিপিএম তা পারে না কেন?
প্রশ্নটা রয়েই যাচ্ছে। |