পুলিশ কিছুই ‘জানে’ না।
বিষমদে মৃতের সংখ্যা শুক্রবার দেড়শো ছাড়িয়েছে। কিন্তু কাটোয়ায় পুলিশের কাছে কোনও ‘খবর’ নেই।
“চোলাই কারবার কোথায় হয়, সে তথ্য আমাদের কাছে নেই। আপনাদের কাছে থাকলে দিন, অভিযান চালাব।” বক্তার নাম শচীন্দ্রনাথ পুড়িয়া, পদমর্যাদায় কাটোয়ার সার্কেল ইনস্পেক্টর।
সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ কাটোয়া শহরের কাছে পানুহাট-মণ্ডলহাটে যেতেই অবশ্য সব ‘তথ্য’ হাতে চলে এল। ঘোষপাড়ায় দুর্গামন্দিরের কাছে একটি বাড়িতে রমরমিয়ে চলছে চোলাইয়ের ঠেক। বাইরে পাহারায় দুই যুবক। অচেনা কাউকে দেখলেই ভিতরে চলে যাচ্ছে ‘সতর্কবার্তা’।
বাড়িতে টিনের চাল। মাটির ঘরের বারান্দায় ছড়িয়ে কয়েকটি চায়ের গ্লাস আর খুচরো পয়সা। বাদাম চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে গেলেন দুই মাঝবয়সী ব্যক্তি। দুই যুবক সবে বাড়িতে ঢুকতে যাবেন, চোখের ইশারায় তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হল, ভিতরে রয়েছে ‘অচেনা লোক’।
‘নন্দ ঘোষ আছেন?’ |
বর্ধমানের পুতুন্ডা গ্রামে মদের ভাটির ছবিটি তুলেছেন উদিত সিংহ। |
ফুলহাতা গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা এক জন এগিয়ে এলেন, “এটা নন্দ ঘোষের বাড়ি নয়। এখানে চোলাই বিক্রি হয় না।” বাইরে বেরিয়ে কয়েক জন খদ্দের অবশ্য জানিয়ে দেন, মগরাহাট কাণ্ডের পরে চোলাই কারবারিরা সতর্ক হয়ে গিয়েছেন। চোলাই এখন প্লাস্টিকের জ্যারিকেনে মাটির ভিতরে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে।
পানুহাট-মঙ্গলহাট এলাকায় চোলাইয়ের ঠেক খান পনেরো। প্রত্যেকটিতেই এখন অচেনা খদ্দের দেখলে সটান বলে দেওয়া হচ্ছে, ‘এখানে মদ বিক্রি হয় না।’ পুকুরপাড় বা গাছতলায় বসে চায়ের গ্লাসে ঘোলাটে চোলাই ঢালতে ঢালতে কিংবা রেললাইনের ধারে পাউচ থেকে গলায় তরল ঢালার সময়ে কয়েক জন খদ্দের খোলসা করেই বলেন, “ব্যবসায়ীরা এ ক’দিন চেনা লোক ছাড়া অন্য কাউকে চোলাই বিক্রি করছে না। চারদিকে মিডিয়া আর পুলিশের নজর যে!”
স্থানীয় সূত্রের খবর, চন্দননগর থেকে ট্রেনে এবং বর্ধমান-গুসকরা থেকে বাসে বড় বড় ‘ব্লাডার’ ভর্তি চোলাই চলে আসে কাটোয়ায়। প্রতি ব্লাডারে ১০-১৫ লিটার চোলাই থাকে। কাটোয়ার দিঘিরপাড়, চাঁপাপুকুরপাড়, পানুহাট, মণ্ডলহাটে ছ’জন পাইকার আছেন। রোজ বিকেলে প্রায় ৪০০ লিটার চোলাই আসে। তার একটা অংশ আবার ছেঁড়াকালীঘাট দিয়ে ভাগীরথী পেরিয়ে নদিয়ায় চলে যায়। বাকি চোলাই বিক্রি হয় পানুহাট-মণ্ডলহাট এলাকায়।
এই মদ বিক্রি হয় দু’ভাবে ৬০০ মিলিলিটার বোতলে আর ৫০ মিলিলিটার পাউচে। বর্ধমানের এই এলাকায় পাউচ সাধারণত ‘ক্যারি’ নামে পরিচিত, দাম ৫ টাকা। বোতলের দাম ৩২ টাকা। ঠেকে অবশ্য গ্লাস হিসেবেও বিক্রি হয়। দাম ঘোরাফেরা করে ৫ থেকে ১০ টাকার মধ্যে। কেতুগ্রামের বেগুনকোলায় অজয় নদের খাদে বড় বড় ডেকচি বা হাঁড়িতেও চোলাই তৈরি হয় বলে খবর। সেই মদ বাইরে পাচার হয়। যদিও কেতুগ্রামের আইসি আব্দুর গফ্ফর দাবি করেন, “বেগুনকোলায় কোনও খবর নেই। তবে আমরা কান্দরা ও বহড়ানে দু’টি ঠেক ভেঙে দিয়ে এসেছি।”
আবগারি দফতরের ৩০-৩৫ জনের একটি দল অবশ্য এ দিনই অজয় পেরিয়ে বেগুনকোলায় হানা দেয়। গ্রামের একটি পরিত্যক্ত কালীমন্দিরে মেলে ১২০ লিটার রেক্টিফায়েড স্পিরিট এবং ৮৪টি বোতলে ২৫ লিটার জাল মদ। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেবেল লাগানো ৯৬টি খালি বোতলও পাওয়া গিয়েছে। সঞ্জয় ঘোষ নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা এই কারবার চালান বলে আবগারি দফতর খবর পেলেও তাঁকে ধরা যায়নি। আবগারি দফতরের অতিরিক্ত কমিশনার পার্বতীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চোলাইয়ের চেয়ে জাল মদ অনেক বেশি বিপজ্জনক। তবে কোথায় কোথায় চোলাইয়ের ঘাঁটি রয়েছে, তার খোঁজও নিচ্ছি।” |