রবিবাসরীয় গল্প
গাধা
বি-এ-বি-টি
ব্যর্থ চিঠি
স্টুপিডিটি,
আর লপ্তে গিলোটিন
দাদা অঙ্ক কী কঠিন...
*
¶দিদি¶
পিঙ্কি আমার বাবা-মায়ের বুড়ো বয়েসের কন্যাসন্তান। বাড়ির কেউ নয়, ও জন্মানোর পর নরম গোলাপি মাংসের দলাটার নামকরণ করেছিল হসপিটালের সিস্টাররা। আদিখ্যেতার চূড়ান্ত। ইমোশনের এমনই প্রাবল্য যে, কোথায় অধিকারের সীমানা থমকে দাঁড়িয়েছে, সে বোধটাই বেমালুম গায়েব। তো, অনধিকারের সেই নাম পাল্টানোর কোনও প্রয়োজনও কেউ বোধ করেনি। বছর দশেক পর, অঙ্ক মাথায় ঢুকত না বলে, দাদাই প্রথম ওর নাম বদলে রাখল ‘ডাঙ্কি’। তার পর থেকে ওটাই চালু হয়ে গেল। মানুষের এই এক স্বভাব। কোনও মানবিক গুণের খামতি বোঝাতে জন্তু-জানোয়ারের রেফারেন্স টানে। যদিও এটা এখন প্রমাণিত যে, মানুষের মতো এমন জব্বর মাপের সেয়ানা জানোয়ার ভূ-ভারতের জল-জঙ্গল-নভাকাশের কোত্থাও আর দ্বিতীয়টি নেই। সেই মানুষ আবার গাধাকে অধম ভাবে। শেয়ালকে ধূর্ত। বাঁদরকে মূর্খ। কুমিরকে ভ্যাবলা। অবশ্য এর একশো আশি ডিগ্রি উল্টো বৃত্তান্তও ইতিহাসে রয়েছে। রোমান এমপারার ক্যালিগুলা (৩৭-৪১ খৃঃ) তাঁর পেয়ারের ঘোড়াটিকে মন্ত্রিত্বের পদ দিয়েছিলেন। যাক সে সব...। এটা তো সবার জানা যে, গাধা এক অতি অবনত চিরভারবাহী জীব। নিতান্তই বাধ্য, প্রভুভক্ত। পেটঘাসের বিনিময়ে মুখ বুজে দিবারাত্রি হেঁটমুখে খাটে। যে কোনও পরিবেশের সঙ্গে আপসে মানিয়ে নেয় দিব্যি। পিঙ্কি, থুড়ি ডাঙ্কিও অনেকটা এমনই। জন্ম থেকেই আতান্তরে পড়ে ও বড় নিরীহ, বাধ্য, শান্ত এক অকারণ চড়-চাপটা হজম করা হেঁটমুখ মেয়ে। দাদা আর আমার থেকে এজ ডিফারেন্স এতটাই বেশি যে, কারও কাছে ওকে আমাদের বোন বলে পরিচয় দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না কখনও। বাবার রিটায়ারমেন্টের আট বছর আগে ও যখন হল, আমি আর দাদা আমাদের কোনও বন্ধু-বান্ধবকে কথাটা জানতেই দিইনি বহু দিন। দাদার তখন সিক্সথ ইয়ার, আর আমার থার্ড। বলতে পারা যায় কাউকে? সম্ভব? কিন্তু... তবু... এ সব খবর কি খুব বেশি দিন গোপন থাকতে পারে? পাড়া থেকে প্রতিবেশী, তার থেকে বন্ধু-বান্ধব জনে জনে জানাজানি হতেই হাসাহাসি টিকাটিপ্পনী, তার পর লোক দেখানি-চোখরাঙানি-সহানুভূতির ছররা। বহু দিন যাবৎ বহু জনের একই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে ‘এখন তুই তোর বোনটাকে ভালবাসতে পেরেছিস তো?’ বস্তুত আমি নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর এখনও পর্যন্ত জানি না। আর তা ছাড়া ভালবাসতে হবেটাই বা কেন? বুড়ো বয়েসে আমার মায়ের পেটে জন্মে আমার মাথা কিনে নিয়েছে নাকি!

মাথায় কাফকা
না মা, না বাপকা
হাতে চাবকায়
কিন্তু ঘায়ে আয়োডিন
দাদা অঙ্ক কী কঠিন...
*

আমি বা দাদা জীবনে একটা দিনের জন্যেও ওকে কোনও দিন কোলে নিইনি। আমাদের কোল আমাদের সন্তানের জন্য, সেখানে ও ভাগ বসাবার কেটা? ও হাঁটতে চলতে শিখে যাওয়ার পরেও ওকে সঙ্গে নিয়ে কখনও বাইরে যাইনি। কারণ, বিবাহিতা মডার্ন মেয়েদের অনেকেই মাথায় সিঁদুর পরে না, শাড়িই পরে না বহুজন। তাই যে কেউ ডাঙ্কির সঙ্গে আমাকে দেখলে আধুনিক মা-মেয়ে বলে ভুল করতে বাধ্য। আমাকে কি পাগলা কুকুরে কামড়েছে যে, ওকে সঙ্গে নিয়ে আমি বাইরে বেরোতে যাব? স্বয়ং বাবাই বলে ট্রান্সফার নিয়ে পাঁই পাঁই করে ভাগলপুরে ভাগলবা হয়ে গেলেন। আর মা-ও লজ্জায়-শরমে আর আমাদের দু’ভাইবোনের কড়া চোখের ভর্ৎসনায় পারতপক্ষে ছুঁয়েও দেখত না ডাঙ্কিকে।
তবু,... হাত-পা ছড়ে কেটে, গড়িয়ে গড়িয়ে বাড়তে থাকল ও। মানুষের প্রথম দিকের সন্তান, গাছের প্রথম ফলের মতন, আদর, ভালবাসা, কেয়ারিং সব কিছুই বেশি বেশি পায় এবং পুরুষ্টু হয়। শেষের দিকেরগুলোয় ভাটা পড়ে যায়। ওপর থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে যেটুকু ওর গায়ে এসে টপকায় সেটুকুই যা। ব্যবস্থাটা আমাদের দেশের এডুকেশন সিস্টেমের ‘চুঁইয়ে নামা’ থিয়োরির জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। উল্টো পিরামিডের মতো, আলো-বাতাস-স্পেস সব কিছুরই সিংহভাগ ওপরটিতেই। ডাঙ্কির বেলাতেও একদম তা-ই। আদর থেকে শুরু করে জামা-জুতো-খেলনা সবটাই আমাদের এঁটোকাটা। পুরনো দিনের জমিয়ে রাখা ব্যাকডেটেড। ভিনটেজ স্পেসিমেন। সে সব বস্তু গায়ে-পায়ে চড়িয়ে ডাঙ্কির কোনও দিনই মাথা উঁচু করে বাইরে বেরোবার ক্ষমতা হত না। তাতে আমাদের কিছুই যেত-আসত না। আমি আর দাদা পিঠোপিঠি ছিলাম। আমাদের দু’জনের আজন্মের গড়ে তোলা নিজস্ব একটা পরিমণ্ডল ছিল। আমাদের নিজের নিজের স্টেডি অ্যাফেয়ার্স ছিল, এই প্রেক্ষাপটে ডাঙ্কি একটা মূর্তিমান আনওয়ান্টেড ভাইরাস, যেখানে কোনও ইমুনাইজেশন প্রোগ্রামই এফেক্টিভ হয় না। বেশ তো চলছিল আমাদের। দুলকি চালে আয়েশে এগিয়ে যাওয়া তেল চুকচুকে-ফুরফুরে স্বচ্ছন্দ জীবন। কোত্থেকে যে দুম করে এমন একটা গাধা বিনিমাগনায় এন্ট্রি পাস পেয়ে গেল! জীবনটা তেতো হয়ে গেল আমাদের। আমরা কিছু দার্শনিক মহামানব নই, সাধারণ দু’হাত দু’পা-ওলা মানুষ নামের জীব। আমাদের সাধারণ জীবনের কিছু আবহমান স্বাভাবিক চলন আছে, কিছু গ্রহণীয় প্যাটার্ন আছে। সেখানে এবম্বিধ জলবিছুটি হোঁচট লাগলে জীবন দুঃসহ হয়ে উঠতে বাধ্য। ফলত ঠিক দু’বছরের মাথায় প্রেমিকের সঙ্গে আমার চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেল, এর জন্য এখনও আমি ডাঙ্কিকেই দায়ী মনে করি। কারণ, ও হওয়ার পর থেকেই আমার প্রেমিক কেমন হাসতে হাসতে বাবা-মা’র সম্পর্কে যেন কত রসিকতা করছে, এমন ভাবে অশ্লীল হুল ফোটাবার লাইসেন্স পেয়ে গেল। তখন থেকেই খুব সহজে হাল্কা চালে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেওয়ার সাহস জুটে গেল ওর। আমার বাবা-মা’র মাথায় নতুন করে আর একটা বার্ডেন চাপার ফলে আমার বিয়েতে তেমন খরচাপাতি করতে পারবে না, অন্তত ডাঙ্কির জন্য কিছুটা তো বাঁচাতেই হবে, ঠারে ঠোরে এ সব কথা শোনাতে লাগল আমাকে। এই রকম দড়ি টানাটানি করতে করতে শেষমেশ সম্পর্কটা ছিঁড়েই গেল।
এবং আমার পক্ষে সেটা বেশ ভালই হল। ওই মক্কেলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে আমার হতটা কী। ওই এঁদোগলি শহরেই থেকে যেতে হত আমাকে মরা ইস্তক। একই পাড়ার ছেলে, দুটো পাড়ার তফাতে একটা বাংলা মিডিয়ামের পাতি ইস্কুল মাস্টার। প্রমোশন-ট্রান্সফারের কোনও বালাই নেই, যেখানে জন্ম, সেখানেই মৃত্যু। ছোট শহরটার অতিক্ষুদ্র পরিমণ্ডলে আজীবন ঘুরপাক খেতে খেতে ওই ডাঙ্কির সঙ্গে দিনে পঞ্চাশ বার মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যেত আমার। তার বদলে বাবা ক্ষমতাতীত খরচাপাতি করে, প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়ে পিসির দেওরপো ওয়েল এস্টাব্লিশড এন আর আই ডাক্তার বর কিনে দিলেন আমায়। বিনা আয়াশে এক্কেবারে মুফতে একটা ধাঁ-চকচকে স্বপ্নের জগতে স্থিতু হয়ে গেলাম আমি, ডাঙ্কি যার দশ হাজার কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যেও সেঁধোতে পারবে না জীবনেও।
ডাঙ্কির বয়েস যখন তেরো, বাবা-মা’র সঙ্গে ছুতোনাতায় ঝগড়া করে, দাদা বউ বগলে চলে গেল কর্মস্থল বেঙ্গালুরুতে, বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখল না কোনও দিন। ঠিক দু’বছরের মাথায় হুট করে বাবা চোখ বুজলেন। বাবার মুখে আগুন দিতেও দাদা বাড়ি আসেনি, শ্মশান থেকেই স্ট্রেট ফ্লাইটে বেঙ্গালুরু। বউদি পাড়ারই মেয়ে, বাপের বাড়িতে ক’দিন থেকে গিয়ে বাবার বাড়ির নিজেদের অংশ বিক্রিবাটা করে ফিরে গেল বেঙ্গালুরু। ডাঙ্কি নামের সার্থকতাটা এখানে ও-ই নাকি উদ্যোগী হয়ে বউদিকে খদ্দের দেখে দিয়েছিল। গাধা কি আর সাধে বলে! আরে বাবা বাড়িটা বিক্রি না হলে, দাদা আর আমার অংশে ভাড়া দিয়েও তো দু’পয়সা আসতে পারত। তা নয়, সাফ জানিয়ে দিল, ওসব ঝক্কি ওর পোষাবে না। সাধে কি আর বলেছে, ধন পাওয়ার সময় গাধারা কানা হয়।

নব খোলা গ্যাসে
উল্লাসে
রেঁধেছে ডাঙ্কি,
সে গাধা যতটুকু রাঁধে
তার চে বেশি কাঁদে
মেয়েলি ঢং কী?
পাত্র ভর্তি তৈল
ফালতু খরচা হৈল
লবেজান।
*

পথটি লম্বা
মধ্যে খাম্বা
সুড়ঙ্গ নামবার
বড্ড এলোমেলো দিন...
দাদা অঙ্ক কী কঠিন..
.’*
¶বোন¶
একুশ তো সবার জীবনেই আসে। আমি গাধা বলে, একুশ বেপাত্তা হয়ে একান্নয় চলে যাবে এমনটা তো হওয়ার নয়। আর তালগাছে কাক এখনও বসে, তাল ঠোকরায়। তারই জেরে কাকতালীয় ভাবে তপনদার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বাইশ বছরের বড়, দোজবরে, দিদির সঙ্গে প্রেমটা ধরলে তেজবরে, আমার বিয়ে হওয়া মাত্র দিদির মস্ত লম্বা আই এস ডি কল, ‘বিয়েতেও আমার এঁটো পাত্তর ছাড়া মুখ ডোবানোর আর জায়গা পেলি না!’ চোখ ধাঁধানো বিয়ে হয়ে দিদি তো বেশ ছিল, আমার বিয়েতে দিদির এমন ক্লেশ জন্মাবে, বুঝতে পারিনি। গাধা তো! জটিল অঙ্ক বুঝতে পারি না। দুনিয়ার যত্তসব ‘কুজ্ঝটিকা অঙ্ক’ কি আমার পাতে এসেই পড়তে হয়!
আমার জীবনে প্রেম আসেনি, এটা সত্যি নয়। তবে চিররুগ্ণা মাও চিরকাল ঘাড়ে থাকবে, মর্নিং স্কুলের চাকরিটাও বজায় থাকবে, পণপর্বে লবডঙ্কাও থাকবে এত কিছু মেনে নিয়ে একমাত্র তপনদাই বিয়েতে এগিয়ে এল। দু’দুটো বাচ্চা রেখে তপনদার বউ স্টোভ বার্স্ট করে মারা গিয়েছে। বড়ই আতান্তর অবস্থা। মা নিয়ে আমার মতোই। আমি গাধার মতো খাটতে পারি, প্রভুর সেবা করতে পারি, কিন্তু শেয়াল-কুকুরের কু-দৃষ্টি তো আর চাপা দিয়ে দিতে পারি না। তাই বেশ খানিকটা ভয়ে ভয়েই রেজিস্ট্রি করে বাবার পদবির বদলে তপনদারটা লাগিয়ে নিলাম। মেয়েদের এই এক সুবিধে। এক পুরুষেরটা মাইনাস করে আর এক জনেরটা প্লাস করা। পদবিটা নিজের হলে বোধ হয় এমন নির্মোহ ভাবে নির্মোক ত্যাগের পর্ব সারা সম্ভব হত না। জীবনে এই প্রথম বার বোধ হয় প্লাসে-মাইনাসে অঙ্কটা ঠিকঠাক হল। তবু দিদি বকল। অনেক টাকা খরচা করে বকল। বকুনির ঝঞ্ঝায় এক স্বর্গরাজ্যের সন্ধানও দিল। বিয়ে না করলেও নাকি, সংসার না থাকলেও নাকি, বুড়ো-অথর্ব হয়ে গেলেও নাকি গাধাদের দেখভালের জন্য একটা নামকরা চ্যারিটি সংস্থা আছে SHADH, আহা, বড় সাধ হয় ‘সেভ হেভেন ফর ডাঙ্কিস ইন দ্য হোলি ল্যান্ড’টিকে স্বচক্ষে এক বার দেখবার। লুসি ফেনসাম-এর ওই সংস্থাটি নাকি ইজরায়েলের নেটানিয়াতে চার একর জমির ওপর বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো, পরিত্যক্ত, ঝুরঝুরে, ক্ষুধার্ত, অসুস্থ বুড়ো ডাঙ্কিদের জন্য একটা স্যাংচুয়ারি করেছে। শতাধিক ডাঙ্কি সেখানে মরণের প্রহর পরম নিশ্চিন্তে গুনে যেতে পারছে। ভাবা যায়! ... ও দিদি তুই আগে বলবি তো! অন্তত সিঁদুরটা পরে ফেলার আগে! তবে ইজরায়েল তো অনেক দূর। যেতে পাসপোর্ট-ভিসা-এয়ার টিকিট লাগে। এ জন্মে কি সম্ভব?
তবে অসম্ভব বলে বোধ হয় এ পৃথিবীতে কিচ্ছুটি হয় না। বছর তিনেক পর দিদিই আমাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার বাম্পার অফার নিয়ে উড়ে এল। আগে একটু ছোট্ট ঘটনা আছে।
দিনকতক আগে গ্যাস বার্স্ট করে রান্নাঘরের একটা দিক উড়ে গেলেও সত্তর ভাগ বার্ন নিয়ে আমি দিব্যি জ্যান্ত আছি। ডাক্তারদের মতে, দারুণ ফাইট দিচ্ছি। আমি পুড়ে গিয়ে যতটা না শক পেয়েছি, তার হাজার গুণ ঝটকা খেলাম দিদিকে চাক্ষুষ করে। বাবা মারা যাওয়াতেও একটা দিনের জন্যেও আসেনি। এত বছরে একটি বারও না। আমি তো মরিনি এখনও, তবু...। আমার ঝলমলে দিদি আমাকে হসপিটালের বেডে দেখামাত্র স্বাভাবিকে শিউরে উঠল ইস্, ডাঙ্কি তো ঝলসে একেবারে পিঙ্কি হয়ে গেছে। চামড়া পুড়ে গুটিয়ে মাংসের গোলাপি রং বেরিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যিস পুড়লাম। তাই হসপিটালে পাওয়া নাম হসপিটালেই ফেরত পেলাম। মহানবী বলেছেন, গাধার ডাক শুনলে জানবে শয়তান কাছাকাছি আছে। গাধা শয়তানকে স্পষ্ট করে দেখতে পায়।
জবানবন্দি নিতে পুলিশ এল, পাহারায় দিদি। পুলিশ অফিসার জানালেন ‘আপনার দিদির বয়ান নিয়েছি। এ বার আপনি একটু কষ্ট করে বলুন, কী করে ঘটল ঘটনাটা।’ আমি অযুত হাতির বল সঞ্চয় করে কেটে কেটে বলতে পারলাম অ্যা-ক-সি-ডে-ন্ট। দিদি ধমকে উঠল, চোপ!
পুলিশ অফিসার: অ্যাকসিডেন্ট? আপনার দিদি তো বলছেন আপনার স্বামীই নাকি..., পাস্ট রেকর্ডও তো একটা রয়েছে।
কথা বলার দম ফুরিয়ে আসছিল, তবু ডুকরে উঠলাম ‘আঁ-আঁ-আঁ-আঁ’ অর্থাৎ কিনা না-না-না-না। দিদি চোখ দিয়ে আমায় ভস্ম করে ফেলছে। অফিসারটি কী বুঝে কী লিখে নিয়ে চলে গেল কে জানে! দিদি পড়ল আমাকে নিয়ে, ‘তুই কী ভেবেছিসটা বলত? কানা লোকেও দেখতে পাচ্ছে এটা তো পণের ষড়যন্ত্র।’ গাধাদের খোপরিতে গ্রে-ম্যাটার কম তো থাকেই না, বিজ্ঞান জানাচ্ছে গাধা তার ধীর-স্থির-স্থিতধী স্বভাবে একপাল অশান্ত ঘোড়াকে একাই সুস্থ করে তুলতে পারে। মুখে কথা জোগালে দিদিকে বলতাম, আমাকে মেরে ওর কী লাভ! দুটো বাচ্চা নিয়ে নতুন করে জলে পড়বে। আমার তো কোনও জমানো সম্পদ, কী একটা এল আই সি-ও নেই। কেন আমাকে কেউ মারতে যাবে? মোটিভেশন কই?
অগত্যার নিস্তব্ধতাতে দিদি দুম করে রেগে গেল তুই নিজেকে কী মনে করিস বল তো? ডাফি? নাকি তপনের সংসারটা গ্যালিপলির ওয়ার ফিল্ড, যে যেখানে যত উন্ডেড বডি সবার স্ট্রেচার বয়ে তুই-ই মরবি? তপ্না কি সিম্পসন? আর তোমাদের যুগলের স্মৃতি স্ট্যাচু ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে অমর হয়ে শোভিত থাকবে?
দিদি কী বলছে দিদিই জানে, আমি উত্তর দিতে অক্ষম। তাই বলে দিদি তো রণে ভঙ্গ দিতে পারে না। ঘণ্টাখানেকের নরমগরম বক্তৃতায় আমাকে যে অফারগুলো দিয়ে গেল, পর পর সাজালে এ রকম:
এ বার থেকে মায়ের সব দায়দায়িত্ব দিদির। যত আয়া লাগে, যত টাকা লাগে দিদির দায়িত্ব
ইচ্ছে না থাকলেও, কেবলমাত্র আমার মুখ চেয়েই তপনদার বাচ্চা দুটোকে হোস্টেলে রেখে বড় করার খরচটাও দিদির দায়িত্ব
নির্ভার আমাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবে, যাতে ছাড়া পেয়ে তপনদা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য আমার টিকিটিরও নাগাল না পায়, যত টাকা লাগে দিদির দায়িত্ব। শর্ত শুধু একটাই তপনদার বিরুদ্ধে বয়ান দিয়ে ওকে জেলে পুরতে হবে। বস্তুত আমাকে কিছুই করতে হবে না, শুধু ঘাড়টি হেলানোর অপেক্ষা।
দিনের পর দিন কর্মহীন বিছানায় শুয়ে থাকতে হলে গাধার মগজেও বুড়বুড়ি কাটতে বাধ্য। কেমন যেন মনে হতে লাগল, মা আর বাচ্চা দুটোর নুনের বোঝা যদি আমি দিদির লোভানো অস্তদিঘির জলে ধপাস করে পড়ে গিয়ে হাল্কা করে নিই, এবং তার বদলে চতুর প্রভু আমার পিঠে হাল্কা তুলোর বস্তা রিপ্লেস করার যে প্রমিসটা করল, তুলো তার চরিত্র বদলে লোহা হয়ে পেড়ে ফেলবে আমাকে। গল্পটা ম্যাথু ফোর্ট-এর সেই বৃত্তান্তের দিকেই গড়াচ্ছে নাকি? সেই গাধাকে দিয়ে পাহাড়ের টঙে মাল বইয়ে নিয়ে গাধাকেই কেটেকুটে রোস্ট করে খাওয়া। হঠাৎ দিদির আমাকে অত উচ্চে নিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন পড়ল? হিসেব মিলছে না। নিয়তি নির্দিষ্ট জলকুমির খেলাটা আমি পাশ কাটাই, সাধ্য কী! আরও একটা ব্যাপারেও হিসেবের গরমিল হচ্ছে, আমার ওই চিরকেলে হাল্কা-ফুলকা দিদি, পারবে একসঙ্গে এতগুলো দায়িত্ব ঘাড়ে চাপিয়ে নিতে? সাতজন্মে অভ্যেস নেই, ভারে-বোঝায় যদি না-ও হয়, স্বর্ণলতিকার অর্থ সামর্থ্য মানেই তো ‘রসাল’-এর মেজাজ-মর্জি। উঁহু, এই ফর্মুলায় আমার অঙ্ক মিলবে না। বরং বোবা হয়ে দিনকতক পড়ে থাকলেই, তিন দিন পর দিদি আপনিই উড়ে যাবে।
গেলও তাই। ছ’মাস পরে আমিও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। তপনদার হাজতবাস শেষ হল। বেকসুর খালাস পেয়ে ফের চাকরি ফিরে পেল, সঙ্গে মোটা টাকা এরিয়ার। গল্পটা এখানেই শেষ হলে বেশ হত। কিন্তু শেষ হয়েও হইল না শেষ।
চার বছরের মাথায় মা চোখ বুজলেন। তারও চার বছর পর দিদি-জামাইবাবু বিদেশের পাট তুলে দিয়ে দেশে এসে স্থিতু হল। জামাইবাবুর পীড়াপীড়িতেই বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েক বার গেছি ওদের বাড়িতে। ডাক্তার তো, নিত্যি দিনের মোটা রোজগারের প্যাকেট ছুড়ে ফেলতেন দিদির সামনে, সোফায়। দিদি অনেকটা নিচু হয়ে থোকাটা কুড়িয়ে নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখত সযত্নে। রোজ রাতের রুটিন, অনেকটা নিচু হওয়া অনেকটা টাকা কুড়িয়ে নেওয়া।
এরও বছর কয়েক পরের কথা। হঠাৎ স্ট্রোকে জামাইবাবু চলে গেলেন। আত্মীয় বিয়োগ বলে কথা। এই প্রথম তপনদা আমার সঙ্গে দিদির বাড়ি এল। এই প্রথম আমিও দেখলাম, জীবনে এই প্রথম বার মাথা-উঁচু-দিদি গোড়ে মালা গলিয়ে দিচ্ছে জামাইবাবুর হাসিমুখ ফটোতে।


* চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের গান থেকে উদ্ধৃত
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.