পেশা এবং নেশা যাঁর ব্ল্যাক হোল, তিনি কি দূরে থাকতে পারেন কল্পবিজ্ঞান থেকে?
গবেষক মহলে যাঁর খ্যাতি ‘জুয়াড়ি পদার্থবিদ’ (গ্যাম্বলার ফিজিসিস্ট) হিসেবে, তিনি কি এড়াতে পারেন নতুন কোনও চ্যালেঞ্জ?
শৈশব, যৌবন এবং এখন বার্ধক্য যাঁর দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায়, তিনি কি মুখ ফেরাতে পারেন হলিউড থেকে?
তিনটি প্রশ্নেরই উত্তর, ‘না।’
হয়তো তাই ব্ল্যাক হোল গবেষণার জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী কিপ থর্ন হাত মেলাচ্ছেন স্টিভেন স্পিলবার্গের সঙ্গে। দু’জনে বানাচ্ছেন ‘ইন্টারস্টেলার’ নামে কল্পবিজ্ঞানের সিনেমা।
লক্ষ-কোটি আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে এক ছায়াপথ থেকে অন্য ছায়াপথে পালানোর ওই গল্পের লেখক ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’ (ক্যালটেক)-এর অধ্যাপক থর্ন। আর ওঁর গল্পে আকৃষ্ট ‘ইটি’-র স্রষ্টা স্পিলবার্গ, যাঁর বাবা ছিলেন ‘শখের জ্যোতির্বিজ্ঞানী’। থর্ন এখন চিত্রনাট্য নিয়ে ব্যস্ত। তিনিই ফিল্মটির কার্যনির্বাহী প্রযোজক। |
সত্তর বছরের থর্ন এখানে এসেছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন গ্র্যাভিটেশন অ্যান্ড কসমোলজি (আইসিজিসি) ২০১১’-য় যোগ দিতে। আইসিজিসি-২০১১ শুরু হল থর্নের বক্তৃতা দিয়ে। বক্তৃতা শেষে আনন্দবাজারকে তিনি বললেন, “বড় হয়েছি হলিউডের সিনেমা দেখে। বিজ্ঞানের মজার ব্যাপারগুলো অযথা বিকৃত না করে ছবির মাধ্যমে বলা যায় কি না, সে ভাবনা বহুদিনের। আমার এবং স্পিলবার্গের যোগাযোগ দু’জনেরই পরিচিত এক বন্ধুর মাধ্যমে। কল্পবিজ্ঞানে স্টিভেনের আগ্রহের কথা সবাই জানে। আমার গল্প নিয়ে ছবি করতে চায় শুনে রাজি হয়ে গেলাম।” তাঁর এবং স্পিলবার্গের সেই বন্ধু লিন্ডা অবস্ট। বললেন, “লিন্ডা পুরনো বন্ধু। প্রথম যোগাযোগ কার্ল সাগানের কাহিনি নিয়ে তৈরি ফিল্ম ‘কন্ট্যাক্ট’-এর সূত্রে। লিন্ডা তাতে কাজ করেছিল। ‘ইন্টারস্টেলার’-এ চিত্রনাট্য লিখতে আমি ওকে সাহায্য করেছি।” ‘কন্ট্যাক্ট’ লেখার সময়ে থর্নই তো নতুন ভাবনার খোরাক দিয়েছিলেন সাগানকে। ‘ওয়ার্ম হোল’ বস্তুটি তো তাঁরই আবিষ্কার? থর্ন বললেন, “হ্যাঁ। সাগান আমার বিশেষ বন্ধু। বলেছিল ওই কাহিনির নায়িকা মহাশূন্যে বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিতে চায়। কী ভাবে তা হবে? ব্ল্যাক হোলের মধ্যে দিয়ে? আমি হিসেব কষে দেখালাম, তা সম্ভব নয়। যেতে হবে ওয়ার্ম হোলের মধ্যে দিয়ে। ওয়ার্ম হোল হল, মহাশূন্যে ‘শর্টকাট’, যার মধ্যে সামান্য দূরত্ব মানে আমাদের ব্রহ্মাণ্ডে অনেক লম্বা পথ। ‘কন্ট্যাক্ট’ উপন্যাস এবং সিনেমায় ওই ওয়ার্ম হোলের মধ্যের পথ দেখানো হয়েছে।”
ব্ল্যাক হোল নিয়ে কাজের সূত্রে থর্ন গবেষণা করেছেন টাইম মেশিন নিয়েও। বিজ্ঞানীরা জানেন, এ ব্যাপারে এক মস্ত গেরো হল ‘গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স’। অতীতে ফিরতে পারলে যে অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা ঘটতে পারে, সেটা বোঝাতে ওই ধাঁধার কথা বলা হয়। ধরা যাক, কেউ টাইম মেশিন বানিয়ে চলে গেল অতীতে। এ বার সে যদি তার নিজের অবিবাহিত ঠাকুরদাকে গুলি করে মারে? তা হলে তো তার নিজের জন্মই হওয়ার কথা নয়! দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানী সুং অন কিমের সঙ্গে গবেষণা করে থর্ন প্রমাণ করেছেন, টাইম মেশিন বানানো সম্ভব নয়। রকেট তৈরির মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যাবে। ‘ইন্টারস্টেলার’-এ কি অতীত বা ভবিষ্যতে ঢুকে পড়ার বর্ণনা থাকছে? থর্ন বললেন, “না, আমার গল্প মূলত স্থান-কালের চারটি মাত্রার বাইরে অন্য এক মাত্রায় অভিযান নিয়ে। আমরা দেখি তিনটি মাত্রা ডান-বাম, সামনে-পিছনে, উপর-নীচ। আইনস্টাইন শিখিয়েছেন, এর সঙ্গে যোগ করা উচিত আরও একটি মাত্রা সময়। আমার গল্প এর বাইরে অন্য একটি মাত্রা নিয়ে। এর বেশি এখনই কিছু বলব না। অপেক্ষা করুন। ২০১৪ নাগাদ ফিল্মটা মুক্তি পাবে।” ‘গ্যাম্বলার ফিজিসিস্ট’ তকমার প্রসঙ্গটা উঠতেই প্রবল হাসলেন থর্ন। বললাম, স্টিফেন হকিং তো আপনার কাছে বাজি হেরেছেন? থর্ন বললেন, “হ্যাঁ, ব্ল্যাক হোল আছে না নেই, সে বিষয়ে বাজি ধরেছিলাম আমরা। হার মেনেছে স্টিফেন।” হকিংয়ের সৌজন্যে বাজির শর্ত হিসেবে থর্নের ঠিকানায় এক বছর ধরে পৌঁছেছে ‘পেন্টহাউস’ পত্রিকা!
আর একটা বাজিতে কিন্তু থর্ন ছিলেন হকিংয়ের পক্ষে। বিপক্ষে মার্কিন বিজ্ঞানী জন প্রেস্কিল। বিষয় ছিল, ব্ল্যাক হোলের মধ্যে যা গিয়ে পড়ে, তার সবই হারিয়ে যায় কি না। ২০০৪ সালে হকিং মেনে নেন যে তিনি হেরে গিয়েছেন এবং শর্তমাফিক এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিট্যানিকার সেট উপহার দেন প্রেস্কিলকে। থর্ন কিন্তু এখনও মনে করেন প্রশ্নটার মীমাংসা হয়নি। তাই তাঁর তরফে প্রেস্কিলকে এখনও কিছু দেওয়ার সময় আসেনি। ‘সত্যেন্দ্রনাথ বোস সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস’-এর আমন্ত্রণে থর্ন কলকাতায় যাচ্ছেন ২৭ ডিসেম্বর। বক্তৃতা দেবেন ওখানে। বিষয় ‘র্যাপড স্পেসটাইম’ স্থান-কালের জ্যামিতির কিম্ভুতকিমাকার অবস্থা। |