এত দিন যা চলতে দেওয়া উচিত হয়নি, বিপর্যয়ের পরে তা-ই থামাতে মাঠে নামল প্রশাসন।
শুক্রবার বর্ধমান, শক্তিগড় ও মাধবডিহিতে হানা দিয়ে প্রায় ১,২৭১ লিটার চোলাই মদ ও ২৮,১০০ লিটার চোলাই তৈরির উপকরণ নষ্ট করেছে জেলা আবগারি দফতর। গ্রেফতার করা হয়েছে তিন মদ প্রস্তুতকারককে। ভাঙা হয়েছে কিছু মদের ঠেক। অনেক মহিলাই আর্জি জানিয়েছেন, সরকার কড়া হাতে এই বিষ-ব্যবসা দমন করুক।
এ দিন সকাল থেকেই বর্ধমান থানা এলাকার হাটু দেওয়ান ও বামচণ্ডীপুর, শক্তিগড়ের পুতুন্ডা, মাধবডিহির বুলচন্দপুর, নলে ইত্যাদি জায়গায় হানা দেওয়া হয়। পুলিশ জানায়, বেআইনি মদ তৈরির অভিযোগে বুলচন্দপুর থেকে দীনবন্ধু রায়, নলে গ্রামের গোপাল দাস এবং পুতুন্ডা থেকে বাসুদেব দাস নামে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শুরুতেই হাটু দেওয়ান এলাকায় গিয়ে কয়েকটি মদের ঠেক ভাঙে আবগারি দফতরের মোবাইল টিম। আটক করা হয় কিছু হাঁড়ি ও জ্যারিকেন। এর পরেই হানা দেওয়া হয় পুতুন্ডা গ্রামে। হাজরাপাড়া ও দাসপাড়ায় দেখা যায়, খড়ের গাদা ও পুকুরে কচুরিপানার আড়ালে চলছে চোলাই তৈরির প্রক্তিয়া। টিনের বাক্স ও জ্যারিকেনে রাসায়নিকের সাহায্যে ভাত পচানোর কাজ চলছে। |
বর্ধমানের পুতুন্ডা গ্রামে মদের ভাটির ছবিটি তুলেছেন উদিত সিংহ। |
আবগারি দফতরের অতিরিক্ত সুপার মানিক সরকার ও ডেপুটি এক্সাইজ কনট্রোলার কল্যাণময় সিংহের নেতৃত্বে ২৫ জনের বাহিনী লাঠি শাবল দিয়ে চোলাই তৈরির উনুন ভাঙে। পরিত্যক্ত ডোবা ও মাঠে ঢেলে দেওয়া হয় টিন ভর্তি মদ। অভিযান চলে দুপুর পর্যন্ত। তবে আবগারি দফতরের লোকেদের গ্রামে ঢোকার খবর পেয়েই বহু চোলাই প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা পালিয়েছেন। তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, কেউ নেই। বাড়ি তালাবন্ধ। আবগারি অফিসারেরা নাম-ধাম লিখে নিয়েছেন। এঁদের বিরুদ্ধে মামলাও রুজু করা হয়েছে। এঁদের নামে আদালত থেকে পরোয়ানা জারি করাতে চাইছেন আবগারি কর্তারা।
বৃহস্পতিবার কাজে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি বর্ধমান থানার ঝিঙ্গুটি গ্রামের খেতমজুর তাপস পাল (৪৩)। শুক্রবার সকালে স্থানীয় তালিতগড় গ্রামের বাঁশঝাড়ে তাঁর দেহ পড়ে থাকতে দেখে কিছু আদিবাসী কিশোর। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে ‘মৃত’ ঘোষণা করা হয়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, চোলাইয়ের ঠেকে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সম্প্রতি অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। বর্ধমান থানা ও জেলা আবগারি দফতর ঘটনাটির তদন্ত শুরু করেছে।
পুতুন্ডা গ্রামের হাজরাপাড়ার বাসিন্দা রঞ্জিত হাজরা বলেন, “সংগ্রামপুরের ঘটনা কাগজে পড়ে আমরা চমকে উঠেছি। গ্রামে যারা মদ তৈরি বা বিক্রি করে, তাদের আমরা বারবার বারণ করেছি। কিন্তু তারা সে কথা কানে তোলে না। অবিলম্বে এই বিষাক্ত মদ তৈরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।” ডেপুটি এক্সাইজ কনট্রোলারের দাবি, “আমরা নিয়মিত চোলাই ধরতে অভিযান চালাই। তা জোরদার করা হয়েছে। গ্রামের মানুষ যদি নিয়মিত ঠেকগুলি সম্পর্কে খবর দেন, কোনও গ্রামেই আর কেউ লুকিয়ে চোলাই প্রস্তুত বা বিক্রি করতে পারবে না।”
আবগারি টিম গ্রামে পৌঁছনোয় এ দিন অন্তর থেকে স্বাগত জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারের মহিলারা। দাসপাড়ার বধূ মাধবী দাসের কথায়, “খবরের কাগজে ভ্যানে চাপানো মৃতদেহের স্তুপ ছবি দেখে চমকে উঠেছি। বিষাক্ত মদের বলি এত জন? গ্রামে চোলাইয়ের ঠেক উঠে যাক, এটা আমরাও চাই। কারণ পুরুষেরা ওই ঠেকে গিয়ে রোজগারের প্রায় সবটাই উড়িয়ে দিয়ে আসেন। তাই আমরা ঠিক করেছি, কোথাও মদ তৈরি হতে দেখলেই পুলিশ বা আবগারি দফতরকে খবর দেব।” অপর বধূ সাধনা দাসের কথায়, “আমার স্বামী নিয়মিত মদের ঠেকে যায়। নেশা করতে করতে ওর শরীরের সমস্ত ক্ষমতা চলে গিয়েছে। পরিশ্রমের কাজ করতে পারে না। আমায় মাঠে-মাঠে খেটে সংসার টানতে হয়। আমি চাই, সরকার মদের ঠেক বন্ধ করুক। তা হলে আমাদের মতো অনেক গরিব পরিবারই বেঁচে যাবে।” |