দার্জিলিঙে হারানো জনভিত্তি ফিরে পেতে গোর্খা ও আদিবাসীদের পৃথক জাতিসত্তাকে ‘যথাযথ মর্যাদা’ দিয়ে দলিল তৈরি করছে সিপিএম। এই দলিলকে স্বীকৃতি দিলে পৃথক তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মূল দাবিকে নীতিগত কারণে সমর্থন করতে হবে সিপিএম-কে। সেই ঝুঁকি নিয়েও পাহাড়ে নিজেদের ‘অস্তিত্ব রক্ষায়’ এই দলিল তৈরি করছে সিপিএম।
আজ, বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে সিপিএমের দার্জিলিং জেলা পার্টির সম্মেলন শুরু। থাকবেন পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি, নিরুপম সেন, কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী, গৌতম দেব। জেলা সম্মেলনের পর ওই দলিল রাজ্য সম্মেলন ও পার্টি কংগ্রেসেও অনুমোদনের জন্য এখন থেকেই সিপিএম নেতাদের একাংশ উদ্যোগী হয়েছেন। কেন দার্জিলিং জেলায় গোর্খা ও আদিবাসীদের মধ্যে সিপিএম ক্রমে ‘ব্রাত্য’ হয়ে গেল, সেই কারণ বিশ্লেষণ করেই এই দলিল তৈরি করা হয়েছে। যা সিপিএমে কখনও
হয়নি। তাই এই দলিলকে ‘ঐতিহাসিক’ বলতে চান দলের একাংশ।
তবে পার্টি কংগ্রেসে এই দলিল গৃহীত হলে সিপিএম-কে পৃথক তেলেঙ্গানা আন্দোলনকেও সমর্থন করতে হবে বলে দলের নেতারাই মনে করছেন। এত দিন সিপিআই ওই আন্দোলন সমর্থন করলেও সিপিএম বিরোধিতাই করেছে। দল বার বার বলেছে, তারা রাজ্যভাগের বিরুদ্ধে। এখন কিন্তু দলের একাংশ মনে করছে, তেলেঙ্গানা আন্দোলনের বিরোধিতা করায় সেখানেও সিপিএম
জনসমর্থন হারিয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশে গত ভোটেই তা স্পষ্ট।
তবে আপাতত দার্জিলিঙের ক্ষেত্রে পৃথক জাতিসত্তার কথা স্বীকার করেও রাজ্য ভাগ না-করেই স্বশাসনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়েছে। দলের মধ্যে বিতর্ক সামাল দিতেই এই সিদ্ধান্ত। দলিলে বলা হয়েছে, সিপিএম পাহাড়ের মানুষের ভাষাগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক বিকাশের পক্ষে। জেলার অন্যতম নেতা তথা রাজ্য কমিটির সদস্য অশোক ভট্টাচার্য সোমবার বলেন, “অতীতে পাহাড়ে অ-নেপালি, গোর্খা ও আদিবাসীদের মধ্যে সিপিএম জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু আজ তা নেই। কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছি, জাতিসত্তার প্রশ্ন ও ভাবাবেগকে আমরা গুরুত্ব দিইনি।” এটা যে ‘ভুল’ হয়েছিল, তা স্বীকার করে অশোকবাবু বলেন, “কমিউনিস্টরা সব সময়ে শ্রেণিগত প্রশ্ন গুরুত্ব দেয়। সে পথেই সমস্যা সমাধানের কথা ভাবে। আমরাও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু তা করতে গিয়ে জাতিগত প্রশ্নকে উপেক্ষা করেছি। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছেন সুবাস ঘিসিং, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা বা আদিবাসী
বিকাশ পরিষদ।”
কোয়ম্বত্তূরে গত পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, জাতিসত্তার বিকাশের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিভিন্ন জাতি-উপজাতি-পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জীবনধারার উন্নয়ন ও নানা সামাজিক উৎপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সে প্রস্তাব কাগজে-কলমেই রয়ে গিয়েছে। একের পর এক আন্দোলনে কার্যত পাহাড় থেকে ‘নিশ্চিহ্ন’ হয়ে গিয়েছে সিপিএম। এখন কোয়ম্বত্তূরের প্রস্তাব সামনে রেখেই দলিল তৈরি হচ্ছে।
বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর তাঁরা অ-নেপালি গোর্খাদের পৃথক জাতিসত্তার প্রশ্নকে গুরুত্ব না-দেওয়াতেই ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, স্বীকার করে অশোকবাবু বলেন, “১৯৫০ সাল থেকে কমিউনিস্টরাই পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিল। ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলে যে স্বশাসিত পার্বত্য পরিষদ গঠিত হয়েছিল, তা আমাদেরই ক্ষমতায় আসার পর গড়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা পাহাড়ের মানুষের ভাবাবেগ বুঝতে পারিনি।” ঘিসিংয়ের দিনের পর দিন নির্বাচন না-করার সিদ্ধান্তও বামফ্রন্ট সরকারের মেনে নেওয়া ‘ভুল হয়েছিল’ বলেও তিনি স্বীকার করেন।
সিপিএমের দলিলে বলা হচ্ছে, তারা পাহাড়ের মানুষের পৃথক জাতিসত্তার বিরুদ্ধে নয়। বরং জাতিসত্তার পূর্ণ মর্যাদার পক্ষে। আলাদা রাজ্যের প্রতি পাহাড়ের মানুষের স্বপ্নকে উড়িয়ে না-দিয়ে আপাতত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের মধ্যেই সিপিএম তাঁদের ভাষাগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক বিকাশের পক্ষে। |