|
|
|
|
বেলা যত গড়িয়েছে, ততই ভিড় বেড়েছে লাশকাটা ঘরের সামনে |
শুভাশিস ঘটক • ডায়মন্ড হারবার |
হাসপাতালের মাইকে ঘোষণা হল, কালিকাপোঁতার আব্দুল মজিদ...। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল উৎকণ্ঠায় থাকা কয়েকটি মুখ। কিছুক্ষণ বন্ধ মাইক। আব্দুল মাজিদের দেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়া হল লাশকাটা ঘরে। পিছনে পিছনে তাঁর পরিবার-পড়শি। আবার খানিক পরে মাইকে ঘোষণা, মন্দিরবাজারের পাঁচু বর...। ফের কান্নার রোল। মানুষগুলি পা বাড়ালেন লাশকাটা ঘরের দিকে। বেলা যত গড়িয়েছে, ততই এ ভাবে হাসপাতাল চত্বরের ভিড়টা সরে গিয়েছে লাশকাটা ঘরের সামনে।
সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালে জড়ো হয়েছিলেন মন্দিরবাজার, উস্থি, খাঁপুর, কচুয়াপাড়া, সংগ্রামপুর, কালিকাপোঁতা, টেকপাঁজা, ভারিউড়ান, গৌরজল, বামনা, সেকেন্দারপুর, ধান্যকাটার মানুষ। ঘরে পড়ে থাকা প্রিয়জনকে বাঁচাতে তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ে এসেছিলেন। চিকিৎসকেরাও সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। কারও চিকিৎসা করা গিয়েছিল। কেউ বা হাসপাতালে নিয়ে আসার পথেই মারা গিয়েছিলেন। সকাল থেকেই মন্দিরবাজার, উস্থি, মগরাহাট থানা এলাকায় অনেক বাড়ি থেকেই ভেসে আসছিল কান্নার রোল। পাড়ায় পাড়ায় ছোট জটলা, গুঞ্জন। মৃতদেহ সৎকার করার জন্য পড়শিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
হাসপাতালের সামনে দুপুরের পর থেকেই ছবিটা ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। একে একে বাড়ছিল মৃতের সংখ্যা। লাশকাটা ঘর থেকে একের পর এক দেহগুলি নিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরছিলেন অনেকে। ডায়মণ্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালের মাইকে মৃতদের নাম ঘোষণা হচ্ছিল। নাম কানে আসতেই হাসপাতাল চত্বরে জড়ো হওয়া তাঁদের পরিজনেরা কান্নায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলেন। অনেকেরই আশা ছিল, প্রিয়জন হয়তো ঘরে ফিরবেন। কিন্তু, ফের মাইকের ঘোষণা তাঁদের সেই আশাকে প্রিয়জনের বিয়োগব্যথায় বদলে দেয় । যত সময় এগিয়েছে মৃতের সংখ্যা এ ভাবেই ক্রমে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। |
|
ঘটনার পরে ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা,
কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় ও সুজন চক্রবর্তী। -ছবি: দিলীপ নস্কর। |
দুপুর ১২টা নাগাদ মাইকে ঘোষণা হল, হারুন রশিদের (৪৫) নাম। নামটা কানে আসতেই হাসপাতালের বাইরে এতক্ষণ ধরে বসে থাকা স্ত্রী রাজেমা বিবি তিন নাবালক ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। পাশে ছিলেন তাঁর শাশুড়ি মর্জিনাবিবি। কিন্তু কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন? পরিবারের একমাত্র রোজগেরে হারুন সংগ্রামপুর স্টেশনের মুটে ছিলেন। মা মর্জিনাবিবি অসহায়ভাবে বললেন, “বৌমা ও তিন নাতি-নাতনিকে নিয়ে এ বার কোথায় যাব। চাষের জমিও নেই। বাঁচব কী করে আমরা?”
সকাল থেকে অচৈতন্য স্বামী উদয় রায়ের (৪৫) পাশে ঠায় বসেছিলেন স্ত্রী সুনিতা রায়। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হাত থেকে স্যালাইনের সূচ ও নাক থেকে অক্সিজেনের নল খুলে নিয়ে গেলেন নার্স। মুহূর্তে একটু চমকে যান সুনিতা দেবী। তবে কী...? আশঙ্কাই সত্যি হল। চিকিৎসকেরা জানালেন, লড়াই শেষ। লাশকাটা ঘরে উদয়বাবুকে নিয়ে যাওয়া হবে। কাঁদতে কাঁদতে সুনিতাদেবীও ছুটলেন লাশকাটা ঘরের দিকে। সেখানেই কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে সুনিতা বলেন, “কাল সন্ধ্যায় মানুষটা চা তৈরি করতে বলে বিস্কুট কিনতে বেরিয়েছিল। ফিরল পেট ভর্তি মদ খেয়ে। মাঝেমধ্যেই এমনটা করত। কিন্তু এদিন ফেরার পরেই বমি করতে শুরু করে। ওর সারা শরীর ভিজে গামছা দিয়ে জড়িয়ে দিই। ভোরের দিকে খিঁচুনি শুরু হতেই ভয় পেয়ে যাই। পাড়ার লোকদের ডেকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এমনটা হবে ভাবতে পারিনি। এখন আমাদের কী হবে? কে খাওয়াবে?” লাশকাটা ঘরের সামনে বসেছিলেন আরও অনেকে। কেউ এসেছিলেন বাবার দেহ নিয়ে যেতে। কেউ অপেক্ষা করছিলেন কখন ছেলের দেহ ছাড়া হবে। তাঁদেরই এক জন কালিকাপোঁতার বৃদ্ধ আসাদ আলি লস্কর। লাশকাটা ঘরে রয়েছে ছেলে বাবলু লস্কর। বৃদ্ধের শুকনো গাল বেয়ে অঝোরে নামছে জলের ধারা। বললেন, “অনেক বার ছেলেকে ও সব খেতে মানা করেছি। কিন্তু কানে নেয়নি।” ওই এলাকারই আবদুল মাজিদও মারা গিয়েছেন। তাঁর দেহ নিতে এসেছিলেন ছেলে সেলিম মোল্লা। তিনি বলেন, “জানি না এ বার কী ভাবে আমাদের সংসার চলবে। আব্বু যে আর নেই বিশ্বাই হচ্ছে না।” বিকেল ফুরিয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে মর্গ চত্বরে। |
|
|
|
|
|